দৃঢ় মুষ্টিবদ্ধ একটা হাত। তবে কোনও ঝান্ডা দেখা যাচ্ছে না। তার বদলে ব্র্যান্ড বিপণির বাহারি ব্যাগ বা রেস্তোরাঁর বাহারি কাঁটা চামচ। সঙ্গে স্লোগান, ‘বেশি কেনাকাটার স্বাধীনতা! বা ‘বেশি খাওয়ার স্বাধীনতা’।
চেনা জাতীয়তাবাদী লব্জে অভ্যস্ত কানে খটকা লাগতে পারে। তবে এই ২০১৫-র গ্লোবাল ভারতে স্বাধীনতা দিবসের মেজাজটা এমন স্লোগানেই ধরা পড়ছে। আর নিছকই মুম্বই, বেঙ্গালুরু বা কলকাতার মতো মেট্রো শহর নয়! এ রাজ্যে দুর্গাপুরের মতো সদ্য সাবালক হতে চাওয়া মেজ শহরেও কেনাকাটা, ঘোরাঘুরি বা খানাপিনার স্বাধীনতার দাবিতে বিজ্ঞাপনী বুলি এখন একটি শপিং মলে ছড়িয়ে পড়েছে।
স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে এই ধরনের দাবি-দাওয়াই এখন দস্তুর। অ্যামাজন, ফ্লিপকার্ট, স্ন্যাপডিল-এর মতো অনলাইন কেনাকাটার পোর্টাল থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিমান সংস্থার টিকিটের দামে নানা কিসিমের অফার। শুধু যে এয়ার ইন্ডিয়া যাত্রীদের বাড়তি ১০ কেজি ওজনের ব্যাগ বইবার ছাড়পত্র দিচ্ছে তা-ই নয়, একদা ঔপনিবেশিক শত্রু ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ পর্যন্ত টিকিটে ছাড় ঘোষণা করেছে। ১৬ অগস্ট টিকিট বুক করলে ১ সেপ্টেম্বর থেকে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ইকনমি ক্লাসের টিকিটে ১৫ শতাংশ ছাড়। একটি রিয়েল এস্টেট গোষ্ঠী ৭ অগস্ট থেকে ৭ সেপ্টেম্বরের মধ্যে মোটে ৫০০ টাকায় ফ্ল্যাট বুকিংয়ের অফার পর্যন্ত বাজারে ছেড়ে দিয়েছে। সংস্থার এমডি সঞ্জয় জৈন তাজ্জব: বিজ্ঞাপন বেরোনোর তিন-চার দিনের মধ্যে উৎসাহীদের ফোনের সংখ্যা বেড়ে তিন গুণ। দক্ষিণ কলকাতার নামী পোশাক বিপণি কণিষ্ক-এর ডিরেক্টর নন্দিতা রাজা বলছিলেন, ‘‘১৫ অগস্ট আবার আমাদের সংস্থার জন্মদিন। ফলে, বচ্ছরকার ছাড়ের টানে দোকান উপচে পড়ছে।’’
একটি মাল্টিপ্লেক্স সংস্থা স্বাধীনতা দিবসের মুভি অফার দিচ্ছে, মোবিকুইকে টিকিট কাটলেই ৩০ শতাংশ টাকা ফেরত। দেশের অন্যতম সাবেক সড়ক জি টি রোডের ধারের খানাপিনার পসরা নিয়ে মল্লিকবাজারে ‘জিটি রুট’ বলে একটি নতুন রেস্তোরাঁও স্বাধীনতা দিবসেই উড়ান শুরু করছে।
‘‘স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিপণনের রমরমা প্রতি বছরই বাড়ছে,’’ বলছেন শহরের বিজ্ঞাপন সংস্থা রেসপন্স-এর পেশাদার জয় আইচভৌমিক। এ যাবৎ, স্বাধীনতা দিবসে দিনভর চ্যানেলে চ্যানেলে দেশাত্মবোধক ছবি, মাল্টিপ্লেক্সে জাতীয়তাবাদী ফিল্ম রিলিজ বারবার দেখতে অভ্যস্ত আমনাগরিকেরা। সেই জাতীয়তাবাদী আবেগটাই বাজারের বিপণনের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে।
সাবেক মিষ্টির দোকানেও আগে কেশর, পেস্তা ও সাদার মিশেলে তেরঙা সন্দেশের পাক হত। নেহরু বা জয়হিন্দ সন্দেশ কিংবা তেরঙা বরফি ঘিরে দিব্যি উৎসাহ দেখা যেত। এ বার বলরামের দোকানে হোয়াইট চকোলেট, পেস্তা, কেশরের ট্রাফ্ল সন্দেশ বা রং দে বসন্তী সন্দেশের রমরমা। তেরঙা মালাই রাবড়ি পেশ করছে রিষড়ার ফেলু মোদকও। আবার মেনল্যান্ড চায়না-ওহ্ ক্যালকাটার কর্ণধার অঞ্জন চট্টোপাধ্যায় বা মার্কোপোলো রেস্তোরাঁর কর্পোরেট ম্যানেজার কল্লোল বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতেও, এই ছুটির দিনটা লোক টানার পক্ষে দারুণ।
বিজ্ঞাপন-নির্মাতা সৌভিক মিশ্রও বলছিলেন, ‘‘স্বাধীনতা দিবসের সঙ্গে এখন ভ্যালেন্টাইন্স ডে, ফাদার্স ডে, মাদার্স ডে ইত্যাদির ফারাক নেই। দেশকে ঘিরে আবেগকে অভিনব ঢঙে পণ্য বিক্রি করতেও ব্যবহার করা হচ্ছে।’’ দিল্লির সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব ডেভেলপিং সোসাইটিজ-এর প্রাক্তন অধিকর্তা তথা রাজনৈতিক তত্ত্ববিদ রাজীব ভার্গব কিন্তু এই জাতীয়তাবাদী আবেগকে খাঁটি দেশপ্রেম বলতে নারাজ। তাঁর কথায়, ‘‘নাগরিকেরা এখন কনজিউমার। দেশপ্রেমের মোড়কে আত্মকেন্দ্রিক মূল্যবোধেরই প্রচার চলছে।’’
কাল, স্বাধীনতা দিবসে অনেক শপিংমলেই তাই জাতীয় পতাকা তোলা হবে। দেশকে ঘিরে ভাল লাগার মেজাজ বা ‘ফিল-গুড’ আবহ রচনার যা অঙ্গ। তবু কোথাও একটা সাবেক ভারতের সঙ্গে সংঘাতও থেকে যাচ্ছে। এখনও স্বাধীনতা দিবসের ছুটিতে রেস্তোরাঁয় মদ পরিবেশন নিষিদ্ধ। জনৈক রেস্তোরাঁ কর্তার সরস টিপ্পনী: ‘‘আনন্দের দিনে স্বাস্থ্যপান নিয়ে কিন্তু-কিন্তুটা থেকেই গিয়েছে!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy