কখনও কলকাতা তো কখনও আবার দিল্লি। সেখানকার বড় হোটেলে নামকরা লোকজনদের নিয়ে এসে ‘কনফারেন্স’ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতেন কৃষ্ণনগরের জাভা এলাকার বাসিন্দা শ্যামল দত্ত। ভুয়ো ডাক্তারি ডিগ্রির কারবার, জাল অশোকস্তম্ভ ব্যবহার, সরকারি নথি জাল করা ও সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার অভিযোগে গত বৃহস্পতিবার কৃষ্ণনগর থেকে শ্যামলকে গ্রেফতার করে সিআইডি। পরে শান্তিপুর ও রানাঘাট থেকে আরও তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়।
সিআইডি-র দাবি, ২০১৫ সালে সংস্থাটি খুলেছিলেন প্রধান অভিযুক্ত শ্যামল দত্ত। একটি ভুয়ো মেডিক্যাল বোর্ডও খোলা হয়। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও সারা দেশে এই বোর্ডের অধীনে ৭৮টি কলেজ খোলা হয়েছে। সেগুলি থেকে এমবিবিএস, বিডিএমএস এবং ডিএমবিএস ডিগ্রি দেওয়া হবে বলে প্রচার করা হয়েছিল। জয়েন্ট এন্ট্রাস বা কোনও রকম পরীক্ষা ছাড়াই ভর্তি নেওয়া হচ্ছিল। বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য ২০১৪ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের একটি ‘গেজেট নোটিফিকেশন’ সকলকে দেখানো হত যাতে সংস্থাটির নাম ছিল।
কলেজ কর্তৃপক্ষ ও পড়ুয়াদের একাংশের দাবি, কেন্দ্রীয় সরকারের ওই ‘গেজেট নোটিফিকেশন’ ও দিল্লি-কলকাতার মতো জায়গায় নামকরা সব লোকজনকে নিয়ে ‘কনফারেন্স’ দেখে কেুই অবিশ্বাস করতে পারতেন না যে এই সবই ভুয়ো। আর এই সুযোগটাকেই কাজে লাগাতেন শ্যামল। পড়ুয়ারাও এ সব দেখে অন্যদের উৎসাহিত করতেন। ‘বায়োকেমিক এডুকেশন গ্র্যান্ট কমিশন’ নামে ওই ভুয়ো সংস্থাটি আবার বিভিন্ন রাজ্যে একটি করে কাউন্সিল গঠন করে। সেই কাউন্সিলই সেই রাজ্যের কলেজগুলিকে অনুমোদন দিত। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এই কাউন্সিলের নাম দেওয়া হয়েছে ‘দ্য স্টেট বায়োকেমিক মেডিক্যাল কাউন্সিল(গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া)।
সিআইডি সূত্রের খবর, ওই কাউন্সিলের প্রধান দফতর শান্তিপুরে। কাউন্সিলের প্রধান দিব্যেন্দু হাজরাকেও গ্রেফতার করেছে সিআইডি। সিল করে দেওয়া হয়ছে শান্তিপুরে কাউন্সিলের দফতরও। ওই দফতরের উপরে শান্তিপুর বায়োকেমিক মেডিক্যাল কলেজ। কলেজের চেয়ারম্যান আবার দিব্যেন্দুবাবুরই স্ত্রী রাখী হাজরা। কাউন্সিলের কর্মীরা জানিয়েছেন, শান্তিপুর ছাড়াও কল্যাণী, কলকাতার ফুলবাগান, সোনারপুর, মেদিনীপুর, উলুবেড়িয়া, বাগনান, রাধারমনপুর, আজিমগঞ্জ, কালিয়াগঞ্জ, শিলিগুড়ি ও মালদহ-সহ কাউন্সিলের কাছ থেকে অনুমোদন নিয়ে মোট ১৩টি কলেজ খোলা হয়েছে। এছাড়াও আরও ছ’টি কলেজের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
কী ভাবে চলত এই কারবার?
ধৃত দিব্যেন্দুর স্ত্রী রাখী হাজরার দাবি, কলেজের অনুমোদনের জন্য দুই দফায় মোট সাড়ে ২২ হাজার টাকা নেওয়া হত। তার মধ্যে ১৭ হাজার টাকা দিতে হত শ্যামল দত্তের ‘বায়োকেমিক এডুকেশন গ্র্যান্ট কমিশন’কে। বাকি টাকা থাকত কাউন্সিলের কাছে। কলেজগুলি থেকে ছাত্র ভর্তি ও মাসিক ফি-র একটা বড় অংশও কেটে নেওয়া হত। এর বাইরেও সংস্থায় কাজ দেওয়ার নাম করেও শ্যামল দত্ত মোটা টাকা তুলেছেন বলে অভিযোগ। রাখীদেবী জানান, তাঁর স্বামী দীর্ঘদিন ধরে হোমিওপ্যাথ চিকিৎসা করেন। বছর তিনেক আগে একদিন শ্যামল দত্ত চেম্বারে এসে বলেন যে, দিব্যেন্দুবাবু নাকি সম্পুর্ণ বেআইনি ভাবে বায়োকেমিক ওষুধ ব্যবহার করছেন। সে জন্য তাঁকে শাস্তি পেতে হবে। সেই থেকে পরিচয়। রাখীদেবী বলেন, ‘‘পরে তিনিই আমাদের এই মেডিক্যাল কমিশনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব দেন। হাতে কেন্দ্রীয় সরকারের গেজেট নোটিফিকেশন, বড় বড় সব লোকজনের উপস্থিতিতে কনফারেন্স দেখে আমাদের কখনও সন্দেহও হয়নি।’’
রাখীদেবীর দাবি, চলতি বছর ১৯ জানুয়ারি দিল্লির একটি পাঁচতারা হোটেলে কনফারেন্সে দিল্লির অনেক নামী লোকজন উপস্থিত ছিলেন। একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শুভেচ্ছাবার্তাও পাঠিয়েছিলেন। কল্যাণীর কলেজের এক কর্তা বলছেন, ‘‘কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে আমরাও যোগাযোগ করেছিলাম। গেজেটও দেখেছি। কিন্তু একবারও আমাদের ভুয়ো বলে মনে হয়নি।’’ কলেজের এক পড়ুয়া শুভঙ্কর অধিকারী বলছেন, ‘‘আমিও দু’টো কনফারেন্সে গিয়েছিলাম। সেখানকার ব্যাপার দেখে তো চমকে গিয়েছিলাম। এর ভিতরে কোনও গণ্ডগোল আছে বলে মনে হয়নি।’’
প্রায় ন’মাস আগে শান্তিপুরের ডাকঘর মোড়ে বাড়ি ভাড়া নিয়ে কাউন্সিলের অফিস শুরু হয়। সেই সঙ্গে কলেজও। এই মুহূর্তে কলেজে পড়ুয়ার সংখ্যা ৭০ জন। বাড়ির মালিক সুব্রত শীল বলছেন, ‘‘লালবাতির গাড়ি দেখে প্রথমে আমাদের সন্দেহ ছিল। কিন্তু কাগজপত্র ও কলেজ ঠিকঠাক চলছে দেখে আর কিছু মনে হয়নি। ছেলেকেও ভর্তি করেছিলাম এই কলেজে। কিন্তু সত্যিটা জানার পরে আমরা সকলেই খুব হতাশ।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy