মৃণাল সেন।
তাঁর সিনেমায় দ্রোহের চেনা মেজাজের মতোই এক ধরনের তারুণ্য ছুঁয়ে থাকত তাঁকে। একমাত্র পুত্র কুণাল সেন, বাবাকে ‘বন্ধু’ বলে ডাকতেন। সচরাচর কাউকে ‘কাকা-মামা’ বলে ডাকার বা পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করারও অনুমতি দিতেন না তিনি।
ভবানীপুরে পদ্মপুকুরের বাড়িতে শায়িত দীর্ঘ অবয়বটির সামনে রবিবার তাই ঈষৎ থমকালেন প্রিয়জনেরা। স্নেহভাজন এক অভিনেত্রী এসে ‘মৃণালদা’র গালে হাত দিয়ে আদর করে গেলেন। বছরের শেষ রবিবারের সকাল চলচ্চিত্ররসিকদের জন্য দুঃসংবাদ বয়ে আনল।
এ দিন বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ নিজের বাড়িতেই প্রয়াত হন মৃণাল সেন। তাঁর দেহ আপাতত তপসিয়ায় ‘পিস ওয়র্ল্ড’-এ রাখা। শিকাগো থেকে পুত্র সম্ভবত কাল, পয়লা জানুয়ারি দেশে ফিরবেন। এর পরেই ৯৫ বছরের প্রবীণ চলচ্চিত্রকারের শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে। গত বছর জানুয়ারিতে স্ত্রী গীতা সেনের মৃত্যুর পরে খুবই একলা হয়ে পড়েছিলেন মৃণাল। তবে মোটের উপরে শরীর সুস্থই ছিল। গত কয়েক দশকের ছায়াসঙ্গী, চিকিৎসক অধৃষ্য কুমারের কথায়, ‘‘কয়েক বার পায়ের হাড় ভাঙা ছাড়া কোনও সমস্যা ছিল না। ডায়াবিটিস, উচ্চ রক্তচাপ কিচ্ছু না। কিছুটা ঠান্ডা লেগেছিল। বয়সজনিত কারণেই চলে গেলেন।’’
সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল ত্রয়ীকে নিয়েই এ দিন আলোচনা চলছিল গলির মুখে। অমিতাভ বচ্চনের টুইটেও তিন জনের নাম। ‘ভুবন সোম’-এ ভয়েস ওভারের স্মৃতিচারণ। মৃণালের সমাজ সচেতন দৃষ্টিকোণ আর সপ্রশ্ন স্বভাবের কথা স্মরণ করেছেন শাবানা আজমি। নাসিরুদ্দিন শাহ লিখেছেন, যা বিশ্বাস করেছেন, একমাত্র সেটা নিয়েই ছবি করেছেন মৃণাল। শ্রীলা মজুমদার শ্রদ্ধা জানাতে এসে বলে গেলেন, ‘‘আমার মতো রোগা, কালো চেহারার মেয়েদের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে খুব বেশি পরিচালক ভাবতেন না।’’
আরও পড়ুন: মানিকদার চোখে থেকে গিয়েছিল মুগ্ধতার রেশ
ঘনিষ্ঠ জনেরা বলছিলেন, কয়েক মাস আগে মলয়ালম পরিচালক আদুর গোপালকৃষ্ণন কত উৎসাহ নিয়ে মৃণালদার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। মৃণাল সেন তো শুধু বাংলা বা হিন্দির নন! ওড়িয়ায় ‘মাটির মনিষ’ বা প্রেমচন্দের কাহিনি অবলম্বনে তেলুগুতে ‘ওকা উরি কথা’ও তিনি করেছেন। ফালকে পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রকারের জন্য এ দিন শোকবার্তায় মিলে গিয়েছেন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি।
৯০ বছরের জন্মদিনের পর থেকে বাড়ির অন্দরেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন মৃণাল। অনেক সময় কিছু কথা ভুলে যেতেন। আবার অন্তরঙ্গ কিছু বন্ধুকে পেলে আড্ডায় মেতে উঠতেন। কমবয়সিদের কাছে এখনকার সিনেমার খোঁজখবরও করতেন। ১৪ মে, ওঁর শেষ জন্মদিনেও সুহৃদদের সাহচর্যে খুশি ছিলেন। আদুর চমৎকৃত হয়েছিলেন, পুরনো সব ছবি নিয়ে কত কথা বলছেন মৃণালদা!
আরও পড়ুন: প্রথম আয় মৃণালদার জন্যই, স্মৃতিসুধা ভাগ করে নিলেন মমতা শঙ্কর
এ দিন মৃণালের মৃত্যুপর্ব নিচু তারেই বাঁধা থাকল। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষকৃত্য বা সরকারি ব্যবস্থাপনায় অন্তিম শ্রদ্ধা পছন্দ ছিল না তাঁর। সেই ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন এলেও বাড়িতে ঢোকেননি। পরিজনরা যা চাইবেন, তা-ই হবে বলে জানানো হয়। পরিবারও মৃণালের ইচ্ছানুযায়ী সরকার বা জনগণ, কারও শ্রদ্ধার্ঘ্যই গ্রহণ করবে না বলে চিকিৎসকের দাবি। অন্যথায় সরকার অবশ্য সহায়তায় তৈরি। শোকবার্তায় এ দিন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘তাঁর মৃত্যুতে চলচ্চিত্র জগতের অপূরণীয় ক্ষতি হল।’’
জন্মদিনে মৃণালবাবুর জন্য লাল গোলাপ নিয়ে বাড়িতে যেতেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। জন্মদিনে দু’জনের কথাবার্তা, বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশের জন্য তাঁর ‘মনের অশান্তি, অস্বস্তি’র স্মৃতিচারণ করে এ দিন বুদ্ধবাবুর প্রতিক্রিয়া, ‘‘মৃণালদা’র চলে যাওয়ার খবর আমার কাছে নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুসংবাদ। বহু বার কলকাতার রাস্তায় তাঁকে পেয়েছি পায়ে পায়ে মানুষের মিছিলে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy