Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

১০ বছর পরে মুক্তি, তাও জেলে ২০ দিন

গারদের অন্ধকার জীবনের দশটা বছর কেড়ে নিয়েছে তাঁর। এক দশক পার করে হাইকোর্টের রায়ে খুনের দায় থেকে বেকসুর খালাস পেয়েছেন তারাপীঠের গ্রাম্য বধূ সুচিত্রা মণ্ডল। কিন্তু মুক্তির পরেও জেল থেকে বেরোতে আরও দিন কুড়ি কাবার হয়ে গিয়েছে।

ঋজু বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০১৬ ০২:৪৩
Share: Save:

গারদের অন্ধকার জীবনের দশটা বছর কেড়ে নিয়েছে তাঁর। এক দশক পার করে হাইকোর্টের রায়ে খুনের দায় থেকে বেকসুর খালাস পেয়েছেন তারাপীঠের গ্রাম্য বধূ সুচিত্রা মণ্ডল। কিন্তু মুক্তির পরেও জেল থেকে বেরোতে আরও দিন কুড়ি কাবার হয়ে গিয়েছে। অবশেষে আজ, বুধবার সিউড়ির জেল থেকে বেরিয়ে মুক্তির আলো দেখার কথা তাঁর।

২০০৬ সালের ৪ এপ্রিল। দেওরকে খুনের দায়ে ওই দিনই নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল সুচিত্রার। সেই থেকে তিনি জেলেই ছিলেন। এতগুলো বছর পরে এ মাসের ৬ তারিখ, পঞ্চমীর দিন হাইকোর্টে বিচারপতি অনিরুদ্ধ বসু ও শঙ্কর আচার্যের ডিভিশন বেঞ্চ তাঁর মুক্তির নির্দেশ দেয়।

৬ তারিখে মুক্তি পেয়েও জেলেই পড়ে রইলেন কেন সুচিত্রা?

কারা দফতরের কর্তারা জানাচ্ছেন, সুচিত্রার নামে আরও একটা মামলা ঝুলছিল। তাতেই দেরি। কী মামলা? সুচিত্রা আগে এক বার হাইকোর্টের নির্দেশে জামিন পেয়েছিলেন। কিন্তু কোর্টে সময় মতো হাজিরা দেননি। তখন তাঁকে ফের গ্রেফতার করার নির্দেশ দেয় আদালত। কোর্টে হাজিরা না-দেওয়ার দায়ে সিউ়ড়ির মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে তাঁর বিরুদ্ধে অন্য একটি মামলা শুরু হয়। সেই মামলাটি তাঁর নামে ঝুলে ছিল। সিউড়ি জেলের ওয়েলফেয়ার অফিসার শুভদীপ মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘হাইকোর্টের রায়ে সুচিত্রা নির্দোষ প্রমাণিত হলেও তাই ওই তরুণীর মুক্তির বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়নি।

শেষ পর্যন্ত মঙ্গলবার সিউড়ি জেল কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের দ্বারস্থ হন। সঙ্গে-সঙ্গেই অবশ্য বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়ে যায়। সন্ধ্যায় আদালত সুচিত্রার বিরুদ্ধে মামলাটি তুলে নেয়। রাত পোহালেই সুচিত্রাকে মুক্তি দেওয়া হবে বলে এ দিন সন্ধ্যায় জানিয়েছেন শুভদীপবাবু। বিষয়টি যদি এত সহজেই মেটার ছিল, তবে কুড়ি দিন দেরি করা হল কেন? আইনজীবীরা মনে করাচ্ছেন, এ দেশে বা রাজ্যে চিত্রতারকা থেকে মন্ত্রীদের জামিনের জন্য প্রশাসনের যুদ্ধকালীন তৎপরতার নজির রয়েছে। মদন মিত্রের জামিনের সময়েও তা দেখা গিয়েছে। কিংবা বছর দেড়েক আগে সলমন খান সাজা পেলে সঙ্গে সঙ্গে তার বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশের মামলা করা হয় বম্বে হাইকোর্টে। আইনজীবী হরিশ সালভের সেই তৎপরতায় এক রাতের জন্যও তখন জেলে থাকতে হয়নি সলমনকে। আইনজীবীদের মতে, বীরভূমের গ্রাম্য বধূর ক্ষেত্রে এই তৎপরতার ছিটেফোঁটা দেখা যায়নি। তাঁদের প্রশ্ন, কারা-কর্তারা কয়েক দিন আগে উদ্যোগী দিলে হয়তো পুজোর মধ্যেই বাড়ি ফিরতে পারতেন সুচিত্রা। আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, সুচিত্রার কোনও আইনজীবী না-থাকাতেই এর আগে জামিনে থাকার সময়ে তিনি নির্দিষ্ট দিনে কোর্টে হাজিরা দিতে পারেননি।

জয়ন্তনারায়ণবাবুই জানালেন, সহায়সম্বলহীন ওই মহিলা গোড়া থেকেই দুর্ভাগ্যের শিকার। অভিযোগ ওঠার সময়ে তাঁর হয়ে কোনও আইনজীবী পর্যন্ত সওয়াল করেননি। শাশুড়ি বউমার বিরুদ্ধে তোলেন। স্বামীও পাশে ছিলেন না। পুলিশ দাবি করে, সাড়ে চার হাজার টাকা ধার নিয়ে তিন জন সুপারি কিলার নিয়োগ করে সুচিত্রাই দেওরকে কুপিয়ে খুন করিয়েছেন। কিন্তু হাইকোর্টের নির্দেশে বিচারবিভাগের অন্তর্গত রাজ্য আইনি পরিষেবা বিভাগ সুচিত্রার হয়ে আইনজীবী নিয়োগ করে। তার পরেই মামলার গতি অন্য দিকে ঘোরে। শেষমেশ হাইকোর্ট তার রায়ে বলেছে, সুচিত্রার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগেরই প্রমাণ মেলেনি। সুচিত্রার সঙ্গে এই মামলার অভিযুক্ত আরও তিন জন নিতাই দাস, কাশীনাথ মাল ও বাদাম শেখকেও নির্দোষ বলে জানিয়ে দিয়েছে হাইকোর্ট। তাঁরা আগেই জেল থেকে বেরিয়েছেন। সুচিত্রার দেওর অশোক তবে কী কারণে খুন হলেন? পুলিশ যথাযথ তদন্তই করেনি বলে মনে করছেন আইনজীবীরা। মাঝখান থেকে সুচিত্রার জীবনের দশটা বছর ঢেকে গেল অন্ধকারে।

তারাপীঠের কাছে মাড়গ্রাম থানা এলাকার অখ্যাত গ্রামে সুচিত্রার ভাই দেবাশিস মণ্ডলকে অবশ্য এ দিন রাত পর্যন্তও বোনের মুক্তির খবর দিতে পারেননি জেল কর্তৃপক্ষ। দেবাশিসবাবুর মোবাইলে বার বার ফোন করেও রাত পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। জেল সূত্রের খবর, ওই ভাই-ই সুচিত্রার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। সুচিত্রা কী ভাবছেন এখন? জেল সূত্রের খবর, অতীত নিয়ে আর ঘাঁটতে চান না ওই তরুণী। জেলে যাওয়ার সময়ে রেখে গিয়েছিলেন কয়েক মাসের ছোট্ট ছেলেকে। সে এখন দশ বছরের বালক। তার কাছে ফিরে যাওয়ার জন্যই ছটফট করছেন সুচিত্রা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Acquittal Freedom
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE