লালুপ্রসাদের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুক্রবার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে।—নিজস্ব চিত্র।
বেলা তিনটে। রাইসিনা পাহাড়ের তাপমাত্রা তখনও চল্লিশের ওপরে। রাষ্ট্রপতি ভবনের অশোক হল থেকে সেই প্রথম প্রধানমন্ত্রীর শপথ অনুষ্ঠান বেরিয়ে এসেছে উঠোনে। ঠাঠা রোদে হাজার পাঁচেকের গলদঘর্ম ভিড়। তার মাঝেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেশ ও বিদেশের কূটনীতি-রাজনীতির ওজনদার মুখেরা, পেজ-থ্রি, গ্ল্যামার দুনিয়া। পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ থেকে অমিতাভ-রেখা-সলমন।
দু’বছর আগের সেই দিনটা ছিল ২৬ মে। এ দিন, শুক্রবার ছিল ২৭। বহু দূরের রাইসিনা পাহাড়েই মিলে গেল কলকাতার রেড রোড। রাজভবন থেকে বেরিয়ে এই প্রথম রাজপথে শপথ নিল বাংলার কোনও সরকার। চল্লিশ বাই চল্লিশ ফুটের মূল মঞ্চে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন শপথ নিচ্ছেন, তখন ডান দিকের আলাদা মঞ্চে বসে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে, বাংলাদেশের শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, অরুণ জেটলি, নীতীশ কুমার, লালু প্রসাদ, ফারুক আবদুল্লা, অখিলেশ যাদব। অমিতাভ-শাহরুখ আসতে না পারলেও মঞ্চের সামনে দেব-ঋতুপর্ণা-সহ টালিগঞ্জের চেনা মুখেরা ছিলেন। ছিলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, সঞ্জীব গোয়েনকা, হর্ষ নেওটিয়ারা। ছিল আম দিদি-অনুরাগীদের ভিড়।
মোদীর ছাব্বিশ আর দিদির সাতাশে তা হলে ফারাক কোথায়?
অনেকেরই উত্তর, ফারাক নেই। থাকার কথাও নয়। কারণ, শপথ অনুষ্ঠান এখন ‘ইভেন্ট’। শুধু সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় আর তা সীমিত নয়। ক’মাস আগেই পটনার গাঁধী ময়দানে শপথ নেন নীতীশ। কেজরীবাল দু’বারই শপথ নিয়েছেন দিল্লির রামলীলা ময়দানে। আর মোদীর শপথে তো ‘সার্ক’ গোষ্ঠীর প্রায় সমস্ত রাষ্ট্রপ্রধান এসেছিলেন।
কাজেই, আগে দেখনদারি, পরে গুণবিচারী— এটাই এখন ট্র্যাডিশন। যেখানে ছবিগুলো কম-বেশি একই। শুধু পাল্টে পাল্টে যায় মুখ। মমতার শপথও এর ব্যতিক্রম নয়।
সর্বভারতীয় রাজনীতিতে এই ধরনের ‘শপথ শো’-এর নতুন হাওয়া এনে দেওয়ার কিছুটা কৃতিত্ব মোদী-কেজরীবালরা নিতেই পারেন। তবে মমতা-ঘনিষ্ঠদের অনেকের দাবি, পেটেন্টটা তৃণমূল নেত্রীরই পাওয়া উচিত। ২০০১-এ আশা জাগিয়েও ক্ষমতায় আসতে পারেননি। কিন্তু সে বার ঠিক করে রেখেছিলেন, বামেদের গদিচ্যূত করতে পারলে শপথ নেবেন ব্রিগেডে। ২০১১-য় রাজ্যে পরিবর্তন ঘটলেও শরিক হিসেবে কংগ্রেস ছিল। সবটা তাই মমতার ইচ্ছেয় হয়নি। কিন্তু এ বার তো তিনি একাই ২১১।
এখানেই রেড রোডের আড়ম্বরের একটা সর্বভারতীয় রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত দেখছেন কেউ কেউ। একে তো বিধানসভায় রেকর্ড-ভাঙা জয়। তার ওপর সংসদের দুই কক্ষ মিলিয়ে মমতার সাংসদ এখন ৪৬। এই দাপটে জাতীয় রাজনীতিতে ওজন অনেকটা বেড়েছে তৃণমূল নেত্রীর। নীতীশ-লালু-অখিলেশ-জেটলিদের মঞ্চে বসিয়ে জাতীয় স্তরে তিনি সেই বার্তাটাই দিলেন বলে মনে করা হচ্ছে।
গত লোকসভা ভোটের পরে কংগ্রেসের নড়বড়ে অবস্থাটা আর শুধরোয়নি। বরং আঞ্চলিক শক্তির গুরুত্ব বাড়ছে জাতীয় রাজনীতিতে। নীতীশ যেমন বিহারের গণ্ডি ছাড়িয়ে দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, অসম সফর করে আসছেন। একই ভাবে এ বার দিদির ব্যস্ততাও বাড়বে বলে অনেকের মত। বস্তুত, লোকসভা ভোটের পর নীতীশ, নবীন পট্টনায়ক, জয়ললিতা, মুলায়মদের নিয়ে ফেডারেল ফ্রন্ট গড়ার মুখ্য উদ্যোক্তা মমতাই ছিলেন।
শপথ নিয়ে নবান্নে পৌঁছতে স্বাভাবিক ভাবেই এ নিয়ে প্রশ্ন উড়ে এল। মমতা বললেন, ‘‘ওঁরা আসায় আমি খুশি। ওঁরাও খুশি। আসলে এটা ছিল একটা রাজনৈতিক মিলন অনুষ্ঠান। চায়ের কাপে ওঁদের সঙ্গে কথা হল।’’ কী কথা? মুখ্যমন্ত্রীর জবাব, ‘‘শুধু তো চা ছিল না, দুধ-চিনিও ছিল।’’ আরও বললেন, ‘‘ফেডারেল ফ্রন্ট একটা খুবই ভাল আইডিয়া। এই সম্পর্ক অর্থনীতিকে ঘিরে হতে পারে, রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতেও হতে পারে।’’ ২০১৯ সালে প্রয়োজনে এই ফ্রন্টের নেতৃত্ব দিতে আপনি তৈরি? দিদি হেসে বলেন, ‘‘আমি আপনার প্রশ্নটা শুনিনি। এখন ২০১৬ নিয়ে ভাবার সময়। ২০১৯ নিয়ে ভেবে কী হবে?’’ ঘন ঘন দিল্লিতে দেখা যাবে আপনাকে? এ বারও হাল্কা চালে মমতার জবাব, ‘‘প্লেনের ভাড়া দিলে নিশ্চয়ই যাব।’’
এ দিন ফেডারেল ফ্রন্ট নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েন জেটলিও। শপথের মঞ্চে ছিল সৌজন্যের আবহ। কিন্তু কলকাতা প্রেস ক্লাবের সাংবাদিক বৈঠকে ওই প্রসঙ্গ শুনে জেটলি বলেন, ‘‘তৃণমূল এবং বিজেপি বন্ধু নয়। ফেডারেল ফ্রন্টের সমর্থন খুব দুর্বল, নেতৃত্বও দুর্বল। এটি হল পরীক্ষিত ও ব্যর্থ একটি প্রয়াস।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy