Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

সমৃদ্ধির চিহ্ন নেই, লক্ষ্মীর ছাপে মগ্ন

কোজাগরী পূর্ণিমার ঝলমলে জোছনাতেও একটা প্রশ্ন অবশ্য হারিয়ে গেল না। যে রাজ্যে নেতারা এমন করে লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ আঁকছেন, সে রাজ্যে সমৃদ্ধির ছাপ কি আদৌ আছে! বাংলায় লক্ষ্মী তো সত্যিই চঞ্চলা! ভক্তিই শুধু অচলা।

প্রস্তুতি: বাড়িতে লক্ষ্মীপুজোর আয়োজনে ব্যস্ত নয়না ও সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার

প্রস্তুতি: বাড়িতে লক্ষ্মীপুজোর আয়োজনে ব্যস্ত নয়না ও সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার

সন্দীপন চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০১৭ ০৩:১৭
Share: Save:

বিসর্জনের বাদ্যি এবং দুর্গাপ্রতিমা নিয়ে কার্নিভালের রোশনাই মিলিয়ে যেতে না যেতেই ঘর আলো করে এ বার লক্ষ্মী। সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি চেয়ে ঘরে ঘরে আঁকা হয়ে গেল লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ। ঘটা করে পুজো হল নেতা-মন্ত্রীদের বাড়িতেও। লক্ষ্মী পুজোর শুভেচ্ছা জানাতে ভুললেন না মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

কোজাগরী পূর্ণিমার ঝলমলে জোছনাতেও একটা প্রশ্ন অবশ্য হারিয়ে গেল না। যে রাজ্যে নেতারা এমন করে লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ আঁকছেন, সে রাজ্যে সমৃদ্ধির ছাপ কি আদৌ আছে! বাংলায় লক্ষ্মী তো সত্যিই চঞ্চলা! ভক্তিই শুধু অচলা।

দুর্গাপুজোর গোটা আয়োজনে কলকাতা জু়ড়ে তৃণমূল নেতাদেরই দাপট। আগেও এই উৎসবে কংগ্রেস বা তৃণমূল নেতাদের পাল্লা ভারী ছিল। তৃণমূল রাজ্যে সরকারে আসার পরে উৎসবে শাসক দলের পৃষ্ঠপোষকতার ছাপ আরও গভীর ভাবে পড়েছে। মা দুর্গার বিদায়ের পরে খালি, বিষণ্ণ মণ্ডপে লক্ষ্মী পুজো করাই রীতি। সেই সঙ্গেই শাসক দলের তাবড় নেতাদের অন্দর মহলেও ধনদেবীর আরাধনা হয়। এ বারও হচ্ছে। দাঁড়িয়ে থেকে লোকজনের খাতির-যত্মের দায়িত্ব নিয়েছেন গৃহকর্তা বা কর্ত্রীরা।

যেমন, সুদীপ ও নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁদের তালতলার বাড়িতে লক্ষ্মীপুজোর আয়োজন রাজ্য রাজনীতিতে সুপরিচিত। মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়, সাংসদ কাকলি ঘোষ দস্তিদার বা বিধাননগরের মেয়র সব্যসাচী দত্তের বাড়িতেও পুজো। রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ির পুজো এ বার অবশ্য বন্ধ পারিবারিক শোকের জন্য। সাংসদ তাপস পালের বাড়ি লক্ষ্মীর আরাধনার আয়োজন আছে। কিন্তু তিনি নিজে ভুবনেশ্বরের হাসপাতালে জেল হেফাজতে। তাঁর স্ত্রী নন্দিনীও স্বামীর পাশে থাকার তাগিদে ওড়িশায়। আবার তৃণমূলের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও মুকুল রায়ের কাঁচরাপাড়ার বাড়িতে আসন ঠিকই পাতা হয়েছে লক্ষ্মীর জন্য। সেই অর্থে ওই লক্ষ্মীর রং এ বার কিঞ্চিৎ গৈরিক!

প্রশ্ন করলে ছোট-বড়-মাঝারি সব নেতাই এক বাক্যে বলছেন, মঙ্গল ও শান্তি কামনায় লক্ষ্মী পুজোর আয়োজন। নিজে ঘটি বলে মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো হয় না। কিন্তু পাড়ার পুজোয় থাকেন। সুব্রতবাবু বলছেন, ‘‘সারা পৃথিবীর এবং সেই সঙ্গে এই বাংলায় শান্তি চাইছি লক্ষ্মীপুজোয়। মঙ্গল কামনাও করছি।’’ কিন্তু শিল্পের আবাহন ছাড়া, নতুন নতুন উদ্যোগের সমৃদ্ধি ছাড়া দেবীর পুজো কি যান্ত্রিক হয়ে ওঠে না? ঠিক যে কারণে এই বাংলায় গণেশ বা বিশ্বকর্মা পুজো নিয়ে উন্মাদনাও এখন চোখে লাগে। এমন প্রশ্নের উত্তর সলজ্জ এড়িয়ে যেতে চাইছেন সব নেতাই। প্রাক্তন এক মন্ত্রী সুদর্শন ঘোষ দস্তিদার জানাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যমগ্রামের বাড়িতে দুর্গামণ্ডপ আছে। দুর্গার পরে স্বাভাবিক ভাবেই সেখানে লক্ষ্মীপুজো হয়। সুদর্শনবাবুর কথায়, ‘‘বহু পুরুষের পুজো। করতেই হয়।’’

এই ‘করতেই হয়’-এর টানেই আসলে বছর বছর হয়ে চলে লক্ষ্মীর আরাধনা। পুজো আয়োজনের রং হয়তো আলাদা হয়, নেপথ্যের কুশীলব হয়তো পাল্টে পাল্টে যান। কিন্তু সমৃদ্ধি আনতে বাংলা সর্বান্তঃকরণে ঝাঁপায় না। কারও কারও আক্ষেপ, একটা কারখানার বিদায়কে যেখানে রাজনৈতিক জয়ের স্মারক হিসাবে দেখা হয়, সেখানে আর কী-ই বা সমৃদ্ধি হবে!

বাংলায় এখনও গৈরিক লক্ষ্মীপুজো অবশ্য তুলনায় অনেক কম। রাহুল সিংহ, প্রতাপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বিজেপি নেতাদের বাড়িতে পুজো হয়। তবে নরেন্দ্র মোদী-অরুণ জেটলিদের আর্থিক নীতি নিয়ে যশবন্ত সিন্হা, অরুণ শৌরিরাই যা প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন, বিজেপি নেতাদের লক্ষ্মীসাধনাও নির্ভাবনায় করার জো নেই! আর রক্তিম লক্ষ্মী আরও অমিল। সিপিএম নেতারা মতাদর্শের ধর্ম মেনেই এ সবে নেই। তবে নেতাদের মা বা স্ত্রীরা কেউ কেউ নিভৃতে লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়েন। দলের নেতা মহম্মদ সেলিমের মন্তব্য, ‘‘কবি বলেছিলেন হও করমেতে বীর, ধরমেতে ধীর। এখন সেই মন্ত্র পরিবর্তন হয়ে দাঁড়িয়েছে— হও ধরমেতে বীর, করমেতে ধীর! কাজে কী হল, কে এখন আর ভাবছে!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE