Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

‘ভ্যালিদা’ রা কাড়ছেন না কেন, জল্পনা জেলে

রবীন্দ্রনাথের চেনা গল্পের হেঁয়ালির ছড়াটা একটু পাল্টে ফেললে দোষ হবে না। পায়ে ধরে সাধা, তবু রা নাহি দেয় দাদা! প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগারের আনকোরা অতিথি গৌতম কুণ্ডুর ভাবগতিক দেখে জনৈক জেলকর্তা মুখ টিপে হাসছেন। পুরনো হেঁয়ালির ছড়াটা সামান্য পাল্টে তিনিই বোঝালেন, বন্দি গৌতমবাবুকে ঘিরে পরিস্থিতি এখন কী রকম!

ব্যাঙ্কশাল আদালতে ঢুকছেন গৌতম কুণ্ডু। —ফাইল চিত্র।

ব্যাঙ্কশাল আদালতে ঢুকছেন গৌতম কুণ্ডু। —ফাইল চিত্র।

শুভাশিস ঘটক
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৪৫
Share: Save:

রবীন্দ্রনাথের চেনা গল্পের হেঁয়ালির ছড়াটা একটু পাল্টে ফেললে দোষ হবে না।

পায়ে ধরে সাধা, তবু রা নাহি দেয় দাদা!

প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগারের আনকোরা অতিথি গৌতম কুণ্ডুর ভাবগতিক দেখে জনৈক জেলকর্তা মুখ টিপে হাসছেন। পুরনো হেঁয়ালির ছড়াটা সামান্য পাল্টে তিনিই বোঝালেন, বন্দি গৌতমবাবুকে ঘিরে পরিস্থিতি এখন কী রকম!

বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থা রোজ ভ্যালির রাজ্যপাটের অধীশ্বর গৌতম কুণ্ডু কেন মুখে কুলুপ এঁটে আছেন, প্রেসিডেন্সি জেলের সংসারে সেটাই এখন সব থেকে জল্পনার বিষয়। বন্দি বা জেলের আধিকারিকদের তরফে তাঁকে যাবতীয় সাধাসাধি এখনও পর্যন্ত বৃথা গিয়েছে। গত বুধবার থেকে জেল-জীবন শুরু হয়েছে গৌতমবাবুর। এর মধ্যে তাঁর মুখ থেকে ক’টা শব্দ নিঃসৃত হয়েছে, তা চাইলে হাতে গোনা যাবে। সবই ‘হুঁ’, ‘হ্যাঁ’, ‘ওঃ’-গোছের।

কেন এমন মেজাজ? এ কি রোজভ্যালি কর্তার স্বভাবসিদ্ধ রাশভারী হাব-ভাব না জেলে ঢুকে মনমরা দশা! নাকি আকাশছোঁয়া অট্টালিকা বা ঢাউস বিদেশি গাড়ির সুখশয্যায় অভ্যস্ত মানুষটি বন্দিজীবনে সমাজের নিচুতলার লোকেদের সংস্রবে ততটা ধাতস্থ হতে পারেননি? জেলের অন্দরে এই নিয়ে তুমুল চর্চা চলতে চলতেই অবশ্য গৌতমবাবুর জন্য একটি আদরের ডাকনাম চালু হয়ে গিয়েছে। তিনি নিজে কারও সঙ্গে আলাপ করুন চাই, না করুন, বন্দিদের মুখে মুখে তিনি এখনই সবার ‘ভ্যালিদা’ হয়ে উঠেছেন।
এমন কী, জেলের কোনও কোনও কর্তারও এই নামটা দারুণ পছন্দ হয়ে গিয়েছে। আড়ালে তাঁরাও রোজ ভ্যালিকর্তাকে ‘ভ্যালিদা’ বলেই ডাকতে শুরু করেছেন ।

গোড়ায় অবশ্য গৌতমবাবুর জন্য ‘স্যার’ সম্বোধনটাই চালু হয়েছিল। জেলে ঢুকেই রোজ ভ্যালির বিনিয়োগকারীদের খপ্পরে পড়েছিলেন গৌতমবাবু। মণীষী ওয়ার্ডের অরবিন্দ সেলে তিনি ঢোকা ইস্তক, রোজ ভ্যালিতে টাকা রাখা ছিঁচকে দুষ্কৃতীরা তাঁকে ঘিরে ‘স্যার, আমার টাকাটা একটু দেখবেন’ বলে নাছোড় আবদারে মেতে ওঠেন। সবার কথা মাথা নিচু করে শোনার সময়ে গৌতমবাবু কিছুই বলেননি। শুধু কয়েক বার অস্ফূটে ‘হুঁ’ বলতে শোনা যায় তাঁকে।

সেলে গৌতমবাবুর সঙ্গে আছেন, আরও জনা ত্রিশ বন্দি। এর মধ্যে ‘বুবাই’ নামে পরিচিত এক সাজাপ্রাপ্ত বন্দিকে জেলকর্তারা ঠারেঠোরে রোজ ভ্যালি-কর্তার কোনও অসুবিধে হচ্ছে কি না, দেখবার দায়িত্বও দিয়ে রেখেছেন। কিন্তু গৌতমবাবু অন্য বন্দি তো দূরের কথা, বুবাইয়ের সঙ্গেও পারতপক্ষে কোনও কথা বলেননি।

গত দেড়-দু’বছরে জাঁদরেল নেতা-মন্ত্রীসুদ্ধ গণ্যমান্য বন্দি কম দেখেননি এ রাজ্যের জেলকর্তারা। তাঁরাও ‘ভ্যালিদা’কে নিয়ে একটু চিন্তায়। সারদা কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত মন্ত্রী মদন মিত্রকে একবার এক নেশাড়ু চোর ‘চোর’ বলে ডেকে ফেলায় অবশ্য তিনি কুরুক্ষেত্র বাধিয়েছিলেন। মদন অবশ্য হাসপাতালেই বেশি, জেলে কমই থাকছেন। তবে এমনিতে শ্রীঘরে ঢুকে ভিআইপিরাও দিব্যি মানিয়ে-গুছিয়ে থাকেন। প্রেসিডেন্সি জেলেই তো রয়েছেন, একদা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিশেষ প্রিয়পাত্র সাংসদ কুণাল ঘোষ। কুণাল জেলে নিজের মনে গান করার জন্য বিখ্যাত। দিস্তে দিস্তে কাগজে তাঁকে লেখালেখি করতে দেখে কেউ প্রশ্ন করলেও তিনি রসিকতা করে থাকেন, ‘প্রেমপত্র লিখছি’! অসমের শিল্পী সদানন্দ গগৈও বন্দিদের গান-টান শোনান। খোশমেজাজে থাকেন ব্যবসায়ী সন্ধির অগ্রবাল। সকালে ট্রাকসুট পরে গা ঘামিয়ে জগিং করেন। মিশুকে স্বভাবের লোক। শুধু ‘ভ্যালিদা’ই যা কারও সঙ্গে মুখে ‘রা’টি কাড়ছেন না।

গৌতমবাবুর এ নীরবতায় কিছুটা ঘাবড়েছেন জেল কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি নিয়ে তাঁরা নিজেদের মধ্যে আলোচনাও করেছেন। রোজ ভ্যালি-কর্তা কোনও গুরুতর অবসাদে ভুগছেন কি না, তা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে বুবাই মারফত গৌতমবাবুর সেলের পড়শিদের কাছে নির্দেশ গিয়েছে, কেউ যেন রোজ ভ্যালিতে বিনিয়োগের কাগজপত্র এনে ‘ভ্যালিদা’কে বিব্রত না-করেন। জেল সূত্রের খবর, প্রথম দিনের পরে গৌতমবাবুকে কেউ খুব বেশি বিরক্ত করেনওনি। কিন্তু তাতেও ‘ভ্যালিদা’র ভেতরের গুমোট ভাবটা কিছুতেই কাটতে চাইছে না।

গৌতমবাবুকে কোনও সুরক্ষিত নিভৃত সেলে রাখার ব্যবস্থা করা যায় কি না, তাও খতিয়ে দেখছেন জেলকর্তারা। মণীষী ওয়ার্ডেই দু’তলায় আবুল কালাম আজা়দ সেলটা এখন ফাঁকা রয়েছে। সেই সেলে খুচখাচ মেরামতি চলছে। আলোচনা চলছে, গৌতমবাবুকে সেখানে সরানো যায় কি না! তবে জেলকর্তাদের একাংশের আবার ভিন্ন মত।
তাঁদের ভয়, একেবারে একা প়ড়ে গেলে রোজ ভ্যালিকর্তা আরও বেশি মুষড়ে না-পড়েন।

জেলের ‘ভ্যালিদা’ তাই আপাতত সেলে অন্য বন্দিদের মাঝেই রয়েছেন। শুক্রবার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসা এক ‘ভিজিটর’-এর সঙ্গে অবশ্য জেলের জালের ভিতর থেকে ফিসফিস করে মিনিট পনেরো কথা বলেছেন। কিন্তু সেলে ঢুকেই ফের স্পিকটি নট! জেল কর্তৃপক্ষ এখন তাঁর জন্য বাইরের খাবার আনায় নিষেধ করে দিয়েছেন। চুপচাপ জেলের সকালের পরোটা-আলুভাজা বা দুপুরের সব্জি-ভাত খেয়েছেন। আর মেঝেয় কম্বল পেতে চুপচাপ বসে থাকছেন, নয়তো নিজের মনেই পায়চারি করে চলেছেন ভ্যালিদা। তাঁর সঙ্গে ভাব করার অনেক চেষ্টা করেও অন্য বন্দি বা জেলকর্তারা এখনও অবধি ডাহা ফেল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE