Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

মেয়েদের নিরাপত্তা নেই, কী করব সাইকেল নিয়ে?

পার্ক স্ট্রিট, কাটোয়া, কামদুনি, মধ্যমগ্রাম, ধূপগুড়ি— লম্বা হয়েই চলেছে তালিকাটা। পশ্চিমবঙ্গে গত কয়েক বছরে নারী নির্যাতনের ভয়ঙ্করতম ঘটনাগুলোর লজ্জা বহন করছে ওই এক একটা নাম। সেই নামগুলোকেই এক অদৃশ্য সুতোয় গেঁথে নিল মরিচবাড়ি।

মরিচবাড়ির বাড়িতে নবনীতা কার্জি। ছবি: হিমাংশুরঞ্জন দেব।

মরিচবাড়ির বাড়িতে নবনীতা কার্জি। ছবি: হিমাংশুরঞ্জন দেব।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০১৫ ০৩:৩৭
Share: Save:

পার্ক স্ট্রিট, কাটোয়া, কামদুনি, মধ্যমগ্রাম, ধূপগুড়ি— লম্বা হয়েই চলেছে তালিকাটা। পশ্চিমবঙ্গে গত কয়েক বছরে নারী নির্যাতনের ভয়ঙ্করতম ঘটনাগুলোর লজ্জা বহন করছে ওই এক একটা নাম। সেই নামগুলোকেই এক অদৃশ্য সুতোয় গেঁথে নিল মরিচবাড়ি।

কোচবিহারের প্রত্যন্ত এই গ্রামের নামটাই যেন ওই লজ্জার তালিকার সামনে একফালি প্রতিবাদ। যে গ্রামের মেয়ে নবনীতা কার্জি সম্প্রতি উত্তরবঙ্গ সফরে আসা মুখ্যমন্ত্রীর বিলি করা সাইকেল নিতে অস্বীকার করেছেন। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী নবনীতা জানিয়ে দিয়েছেন, রাজ্যে লাগাতার নারী নির্যাতনের ঘটনার প্রতিবাদেই তাঁর এই সিদ্ধান্ত। পাশের জেলা আলিপুরদুয়ারে তাঁর স্কুল। কৃষিজীবী বাবা তাঁকে সাইকেল কিনে দিতে পারেননি। তা সত্ত্বেও সরকারের বিনি পয়সার সাইকেল প্রত্যাখ্যান করে রোজ আড়াই কিলোমিটার হেঁটে স্কুলে যাতায়াত করার কষ্ট হাসিমুখে মেনে নিয়েছেন নবনীতা।

আলিপুরদুয়ার তপসিখাতা হাইস্কুলের দ্বাদশ শ্রেণির এই ছাত্রীর কথায়, ‘‘সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই মেয়েদের ওপর আক্রমণের নানা খবর দেখি। মনে হয়েছে, একটা প্রতিবাদ অন্তত দরকার।” রাজ্যের পরিস্থিতি যদিও তার পরেও বদলায়নি। দিন দুয়েক আগেই কাকদ্বীপে প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়ে ফেরার পথে খুন হয়েছেন এক মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। পরিবারের অভিযোগ, খুনের আগে ধর্ষণও করা হয়েছিল তাঁকে। সেই খবর শুনে নবনীতা বলেছেন, ‘‘ধারাবাহিক ভাবে এমন ঘটনা ঘটে চলেছে। যে ভাবে ওকে খুন করা হয়েছে, তা অত্যন্ত লজ্জাজনক।’’

গত অক্টোবরে নবনীতাদের পাশের গ্রাম খোল্টার বাসিন্দা এক কলেজ ছাত্রীর ওপর অ্যাসিড হামলা হয়েছিল। তারও আগে কোচবিহারের এবিএন শীল কলেজের পড়ুয়া, আলিপুরদুয়ারের বাসিন্দা অন্য এক তরুণীর গায়েও অ্যাসিড ছুড়েছিল কেউ। ওই অ্যাসিড-আক্রান্তদের এক জন নবনীতার বান্ধবীর দিদি। প্রতিবাদের সংকল্পটা আরও মজবুত হয়ে উঠেছিল তখনই। সেই প্রতিবাদের তাগিদ থেকেই রাজ্য সরকারের কন্যাশ্রী প্রকল্পের ফর্ম পূরণ করেননি নবনীতা। তার পর চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে জানতে পারেন মুখ্যমন্ত্রীর উত্তরবঙ্গ সফরে সাইকেল বিলির কর্মসূচির কথা।

৩ নভেম্বর মুখ্যমন্ত্রীর সভায় যারা সাইকেলের টোকেন নিয়েছিল, তাদের মধ্যে নবনীতার স্কুলের বেশ কিছু পড়ুয়া থাকলেও নবনীতা ছিলেন না। তিনি সে দিন স্কুলেই যাননি। নবনীতার কথায়, “আলিপুরদুয়ারে মুখ্যমন্ত্রীর সাইকেল বিলির অনুষ্ঠানে প্রাপকদের তালিকায় আমারও নাম ছিল। কিন্তু যেখানে মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে এত সমস্যা, সাইকেল দিয়ে কী করব? সাহসে ভর করে স্কুলে জানিয়ে দিই, সাইকেল নিতে যাব না।’’ নবনীতার স্কুলের প্রধান শিক্ষক সুব্রত দত্ত অবশ্য এই সাইকেল প্রত্যাখ্যান নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলতে চাননি। তাঁর বক্তব্য, “এ রকম একটা বিষয় কানে এসেছিল। তবে সত্যতা যাচাই করা হয়নি।’’ তবে মরিচবাড়ি-খোল্টা পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রধান নিভা কার্জি বিষয়টি জানেন। তিনি বললেন, “সাইকেল প্রত্যাখ্যান শুধু নয়, ও কন্যাশ্রীর ফর্মও পূরণ করেনি বলে শুনেছি। এ সব ব্যক্তিগত বিষয়। তবে নিলে ভাল হতো।”

যদিও ‘সরকারি’ সাইকেল ফেরানো নিয়ে নবনীতাকে কটাক্ষ-কৌতুক করতে ছাড়ছেন না তাঁর গ্রামেরই অনেকে। কেউ কেউ জুড়ে দিচ্ছেন রাজনীতির রং। কারণ নবনীতার বাবা নারায়ণ কার্জি এলাকায় সিপিএম সমর্থক বলেই পরিচিত। তৃণমূলের কোচবিহার জেলা সভাপতি রবীন্দ্রনাথ ঘোষ বলছেন, “অল্প বয়সের ছাত্রীটিকে ওই ভুল সিদ্ধান্ত নিতে কেউ প্ররোচিত করেছে বলে মনে হচ্ছে। রাজ্যে নারী নিরাপত্তা নিয়ে কোনও সমস্যা নেই।’’ যার জবাবে সিপিএমের কোচবিহার জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মহানন্দ সাহা বলছেন, “শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে প্ররোচনার তত্ত্ব দেওয়া হচ্ছে। রাজ্য জুড়ে নারীরা কতটা সুরক্ষিত, মানুষ জানেন। দ্বাদশ শ্রেণির ওই ছাত্রী সাহসী। তাই নিজের মতো করে প্রতিবাদ করেছেন।”

নবনীতার বাবা নারায়ণবাবুও অস্বীকার করলেন না, তিনি সিপিএম সমর্থক। কিন্তু একই সঙ্গে বললেন, “মেয়ের ওই সিদ্ধান্তের কথা আগে এতটুকুও জানতাম না। প্ররোচনার প্রশ্নই নেই। তা ছাড়া মেয়ে তো সরকারের বিরোধিতা করেনি। একটা সামাজিক সমস্যার প্রতিবাদ করতে চেয়েছে মাত্র।” নবনীতার বাবা জানালেন, তাঁদের বাড়িতে নিয়মিত খবরের কাগজ আসে। মেয়েদের উপর নির্যাতনের কোনও খবর বেরোলেই নবনীতা তা নিয়ে অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করেন। ঠিক যেমন কাকদ্বীপের ঘটনা নিয়েও নিজের মতামত জানাতে দ্বিধা করেননি তিনি। নিজের গ্রামেরই নানা লোকের বক্রোক্তির কথা শুনে নবনীতা বলেছেন, “যে যা বলছেন বলুন।”

তবে নবনীতার পাশেও রয়েছেন অনেকে। যেমন কামদুনির দুই প্রতিবাদিনী মৌসুমি কয়াল এবং টুম্পা কয়াল। দু’জনেরই বক্তব্য, রাজ্যে মহিলাদের নিরাপত্তা যেখানে প্রশ্নের মুখে, সেখানে সাইকেল বিলি করার যৌক্তিকতা কতটা? কাকদ্বীপের ঘটনাকে ‘দ্বিতীয় কামদুনি’র সঙ্গে তুলনা করে মৌসুমি বলছেন, ‘‘সাইকেল ফেরত দেওয়াটা খুব যুক্তিসঙ্গত কাজ হয়েছে। চার পাশে এই ধরনের এত ঘটনা ঘটছে। এখনও পর্যন্ত একটাও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি। রাজ্য যেখানে মেয়েদের নিরাপত্তাই দিতে পারছে না, সেখানে সাইকেল দিয়ে কী লাভ!’’ টুম্পার ক্ষোভ, কামদুনির ঘটনার ১৫ দিনের মধ্যে দোষীদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়ার কথা বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। দু’বছরেও কারও সাজা হয়নি। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘এক জন মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর রাজ্যে মেয়েদের নিরাপত্তার এই অবস্থা কি ঠিক? সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে মেয়েরা যদি বিপদের মুখে পড়ে, তখন কী হবে? আগে পরিস্থিতি বদলানো দরকার।’’ শুধু মৌসুমি-টুম্পা নন, দেশে সাম্প্রতিক অসহিষ্ণুতার প্রতিবাদে বিশিষ্ট জনেদের একাংশের জাতীয় পুরস্কার ফেরানোর সঙ্গে নবনীতার সাইকেল প্রত্যাখ্যানের তুলনা টানছেন কেউ কেউ। আবার ‘হোক কলরব’ আন্দোলনের সময়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে আচার্যের হাত থেকে পদক নিতে অস্বীকার করা ছাত্রী গীতশ্রী সরকারের কথাও মনে পড়ছে অনেকের।

নবনীতা সে খবর পেয়েছেন কি না, জানা নেই। আড়াই কিলোমিটার হেঁটে রোজ স্কুলে যেতে কষ্ট হচ্ছে না? প্রতিবাদিনীর ছোট্ট জবাব, ‘‘অনেক দিনের অভ্যাস আমার। খানিকটা বেশি সময় লাগছে, এই যা!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

women security bengal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE