Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

আইনজীবীদের কর্মবিরতির প্রবণতা থেকে সরে আসার আর্জি প্রধান বিচারপতির

বার কাউন্সিল আয়োজিত জাতীয় সেমিনারের মঞ্চ থেকে আইনজীবীদের কর্মবিরতির প্রবণতা থেকে সরে আসার আর্জি জানালেন কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর। ঘনঘন এবং হঠকারী ভাবে আদালতের কাজ বন্ধ হতে থাকলে, সাধারণ বিচারপ্রার্থীরা আইনজীবীদের উপর থেকে ‘আস্থা’ হারাবেন বলেও শিলিগুড়ির দীনবন্ধু মঞ্চে সেমিনারে সর্তক করেছেন প্রধান বিচারপতি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৫ ১৯:১৩
Share: Save:

বার কাউন্সিল আয়োজিত জাতীয় সেমিনারের মঞ্চ থেকে আইনজীবীদের কর্মবিরতির প্রবণতা থেকে সরে আসার আর্জি জানালেন কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর। ঘনঘন এবং হঠকারী ভাবে আদালতের কাজ বন্ধ হতে থাকলে, সাধারণ বিচারপ্রার্থীরা আইনজীবীদের উপর থেকে ‘আস্থা’ হারাবেন বলেও শিলিগুড়ির দীনবন্ধু মঞ্চে সেমিনারে সর্তক করেছেন প্রধান বিচারপতি। এই প্রবণতা চলতে থাকলে বিচারব্যবস্থা ভেঙে পরে ‘অরাজক’ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলেও প্রধান বিচারপতির আশঙ্কা। বিচারপতি চেল্লুরের পরে সেমিনারে বক্তব্য রাখেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অরুণ মিশ্র। তিনিও মন্তব্য করেন, ‘‘বিচারপ্রার্থীরা আদালতে না এলে কিন্তু আমাদের সকলকেই জবাবদিহি করতে হবে।’’

কলকাতা হাইকোর্ট হোক বা বিভিন্ন জেলায় আদালতে কর্মবিরতি যে তিনি পছন্দ করেন না তা একাধিকবার প্রধান বিচারপতি চেল্লুর জানিয়ে দিয়েছিলেন। এর আগে গত জানুয়ারি মাসে শিলিগুড়িতে এসেছিলেন প্রধান বিচারপতি। সে সময়ে শিলিগুড়ি আদালতেই নানা দাবিতে আইনজীবীদের কর্মবিরতি চলছিল। শিলিগুড়ি আদালত পরিদর্শন করে, আইনজীবীদের সঙ্গে আলোচনায় বসে প্রধান বিচারপতি চেল্লুর জানিয়ে দিয়েছিলেন, আগে আদালতের কাজকর্ম স্বাভাবিক করতে হবে। কর্মবিরতি নিয়ে প্রধান বিচারপতির ‘বিরক্তি’ বুঝে পরে কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে নেয় শিলিগুড়ি বার অ্যাসোসিয়েশন। এ বার অবশ্য আইনজীবীদের সর্বোচ্চ সংগঠন বার কাউন্সিলের জাতীয়স্তরের সেমিনারে উপস্থিত থাকতেই প্রধান বিচারপতি শিলিগুড়িতে এসেছেন।

জাতীয় ও রাজ্য বার কাউন্সিল যৌথ ভাবে শিলিগুড়ির দীনবন্ধু মঞ্চে দু’দিনের সেমিনারের আয়োজন করেছে। এ দিন শনিবার ছিল সেমিনারের উদ্বোধনী পর্ব। প্রধান বিচারতি চেল্লুর ছাড়াও, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অরুণ শর্মা, কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী সহ বার কাউন্সিলের জাতীয় ও রাজ্য বার কাউন্সিলের পদাধিকারীরা এবং বিভিন্ন রাজ্যের আইনজীবী প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। ছিলেন রাজ্য বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ও।

এ দিনের সেমিনারের অন্যতম বিষয় ছিল ‘বেঞ্চ এবং বারের সম্পর্ক’। প্রায় ২৬ মিনিটের বক্তৃতায় প্রধান বিচারপতি চেল্লুর বারবারই কর্মসংস্কৃতি প্রসঙ্গ এনেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘এক-দু’দিন পরে পরেই কোনও না কোনও আদালতে বনধ হয়। আইনজীবীরা আদালতকে, বিচারপতিতে সাহায্য করবেন। তবেই তো দ্রুত বিচার সম্ভব হবে। বিচারপতি এবং আইনজীবীরা কেউ কারও শত্রু নয়, আমাদের মধ্যে কোনও যুদ্ধও নেই।’’ কাজ করতে গেলে যে কোনও ধরণের সমস্যা হলে আলোচনার মাধ্যমেই নিষ্পত্তি সম্ভব বলেও তিনি মনে করেন। কী ভাবে সমস্যা মেটানো যাবে তাও প্রধান বিচারপতি চেল্লুর বক্তব্যে জানিয়েছেন। নিম্ন আদালত থেকে জেলা জজ, হাইকোর্টের প্রটফোলিও জজ এমনকী প্রধান বিচারপতির মধ্যস্ততায় আলোচনা হতে পারে বলে জানিয়েইই প্রধান বিচারপতি চেল্লুরের মন্তব্য, ‘‘এ সব না করে হঠাৎই একদিন সকালে আদালতের কাজকর্ম বন্ধ করে বনধ বা কর্মবিরতি শুরু করে দেওয়া ঠিক নয়। কারণ বিচারব্যবস্থার মূল প্রাণশক্তি হল সাধারণ মানুষ। তারা যদি বিশ্বাস, আস্থা হারিয়ে ফেলে তবে এই ব্যবস্থাই ভেঙে পড়বে। একনায়কতন্ত্র, গুণ্ডারাজ তৈরি হবে।’’

কোনও আইনজীবীর মৃত্যু হলে একদিনের ছুটি নিয়েও তার অপছন্দ জানিয়ে দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি। তাঁর মন্তব্য, ‘‘আমরা তো কারও মৃত্যু আটকাতে পারি না। কারও মৃত্যু হলে সকাল থেকে আদালত বন্ধ করে দেওয়াটা ঠিক হতে পারে না।’’ চেল্লুরের প্রশ্ন, ‘‘এতে মৃতের আত্মাও কী বেশি শান্তি পায়?’’ কোনও আইনজীবী সদস্যের মৃত্যু হলে সপ্তাহে একদিন কাজ করে স্মরণসভা করা যেতে পারে বলেও প্রস্তাব দেন তিনি। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভারও আইনজীবীদের ওপরেই ছেড়ে দেন তিনি। প্রধান বিচারপতির আগে বক্তব্য রেখেছেন রাজ্য বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি অবশ্য কর্মবিরতি প্রসঙ্গ না আনলেও, আইনজীবীদের আরও ধৈর্যশীল হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘ইদানিং আইনজীবীদের একাংশের মধ্যে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। তাঁদের আরও স্থির এবং শান্ত হতে হবে।’’ বিমানবাবু নিজেও আইনজীবী।

প্রধান বিচারপতির মন্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছেন শিলিগুড়ির আইনজীবীদের একাংশও। প্রবীণ আইনজীবী মলয় চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘প্রধান বিচারপতি যা বলেছেন তা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। শিলিগুড়ি আদালতে বছরে অন্তত পনেরো দিন কারও মৃত্যুর কারণে কাজ বন্ধ থাকে। তবে পেশা চালিয়ে যাওয়া কোনও আইনজীবীর মৃত্যু হলে, শোকপ্রকাশের সুযোগ থাকা প্রয়োজন।’’ আরেক প্রবীণ আইনজীবী মিলন সরকারের কথায়, ‘‘প্রধান বিচারপতি যা বলেছেন তার বাস্তবতা রয়েছে। আবার কোনও সদস্যের মৃত্যুর সঙ্গে আইনজীবীদের আবেগও জড়িয়ে রয়েছে। সকলে আলোচনা করেই শোক প্রকাশের এমন একটি উপায় বের করতে হবে যাতে বিচারপ্রার্থীদের হয়রান হতে না হয়।’’ বিচারপতির সঙ্গে সহমত প্রকাশ করেছেন আইনজীবী অখিল বিশ্বাস। তাঁর কথায়, ‘‘প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ সহমত। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের স্পষ্ট নির্দেশও রয়েছে।’’

এদিন শিলিগুড়ি বার অ্যাসোসিয়েশনের আমন্ত্রণে আদালত চত্বরে অ্যাসোসিয়েশনের অফিসে গিয়েছিলেন প্রধান বিচারপতি চেল্লুর এবং বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী। শিলিগুড়ি বারের আইনজীবীদের তরফে শিলিগুড়ি আদালতকে দ্রুত মেট্রোপলিটন আদালত হিসেবে ঘোষণা করা, ভক্তিনগর থানার সমস্ত মামলা শিলিগুড়ি আদালতের আওতায় নিয়ে আসা, পকসো, বিদ্যুৎ সংক্রান্ত মামলা ও তফসিলি জাতি ও উপজাতি সংক্রান্ত মামলাগুলি শিলিগুড়িতে শুনানির দাবিতে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। বাকিগুলি নিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আশ্বাস জানানো হলেও, ভক্তিনগর থানার মামলার ব্যপারে সরাসরি হস্তক্ষেপ করবেন না বলে জানিয়ে দেন প্রধান বিচারপতি। তিনি আইনজীবীদের বলেন, ‘‘এই ক্ষেত্রে দুই জেলার বিষয় জড়িত রয়েছে। তাই রাজ্য সরকারকেই বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করে হাইকোর্টের কাছে সুপারিশ করতে হবে। হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ ব্যপারে কিছু করতে অসুবিধা রয়েছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

high court chief justice manjula
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE