Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

নেতা চান, পিজি তাই তৈরি ছিল কুকুরের ডায়ালিসিসেও

হাসপাতালের অধিকর্তা অনুমতি দিয়ে দিয়েছিলেন। বিভাগীয় প্রধানও নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন বিভাগীয় চিকিৎসকদের কাছে। কিন্তু সেখানে গিয়েই আটকে গেল প্রস্তাব। একটি কুকুরের ডায়ালিসিস আর করা গেল না এসএসকেএমের নেফ্রোলজি বিভাগে। এক যুগান্তকারী অঘটনের সাক্ষী হতে হতে বেঁচে গেল এসএসকেএম (পিজি) হাসপাতাল। সৌজন্যে তৃণমূলের চিকিৎসক নেতা নির্মল মাজি।

অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।

অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ জুন ২০১৫ ০৩:৪৫
Share: Save:

হাসপাতালের অধিকর্তা অনুমতি দিয়ে দিয়েছিলেন। বিভাগীয় প্রধানও নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন বিভাগীয় চিকিৎসকদের কাছে। কিন্তু সেখানে গিয়েই আটকে গেল প্রস্তাব। একটি কুকুরের ডায়ালিসিস আর করা গেল না এসএসকেএমের নেফ্রোলজি বিভাগে।

এক যুগান্তকারী অঘটনের সাক্ষী হতে হতে বেঁচে গেল এসএসকেএম (পিজি) হাসপাতাল।

সৌজন্যে তৃণমূলের চিকিৎসক নেতা নির্মল মাজি। যিনি কিনা রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের সভাপতি, চিকিৎসকদের সংগঠন ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের রাজ্য প্রধান। এই সে দিনও ছিলেন স্বাস্থ্য দফতরের ভারপ্রাপ্ত পরিষদীয় সচিব। স্বাস্থ্যভবনের খবর, চিকিৎসকদের বদলি তাঁর হাতে। কোন হাসপাতালের কে সুপার হবেন, কে অধ্যক্ষ হবেন, তা-ও ঠিক করে দেন নবান্নের অতি ঘনিষ্ঠ ওই তৃণমূল নেতা। তাই তাঁর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ার কুকুরের ডায়ালিসিস যে এসএসকেএমে হবে— এমন প্রস্তাবে অস্বাভাবিকতা কিছু দেখছেন না রাজ্যের স্বাস্থ্য-কর্তারা।

এসএসকেএমে ডায়ালিসিসের জন্য ঘুরে-ঘুরে মরণাপন্ন রোগীরা যেখানে ‘ডেট’ পান না, দিনের পর দিন অপেক্ষা করে বসে থাকতে হয়, সেখানে নিজের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ার কুকুরের জন্য রাজ্যের সুপার স্পেশ্যালিটি ওই হাসপাতালের ডায়ালিসিস ওয়ার্ডে সব ব্যবস্থা পাকা করেও নির্মলবাবুর কিন্তু এতটুকুও হেলদোল নেই। বরং নিজের এ হেন উদ্যোগের পক্ষে তিনি যুক্তিও শানাচ্ছেন। ‘‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর। কুকুরটা খুব সুন্দর, ছটফটে। তিন মাস ধরে কষ্ট পাচ্ছিল। তাই এসএসকেএমের একটা হেল্প নিতে চেয়েছিলাম।’’— বলছেন শাসকদলের চিকিৎসক নেতা। তাঁর যুক্তি, ‘‘পশু হাসপাতালে ডায়লিসিসের ব্যবস্থা নেই। সেখানকার সার্জনদেরও অনুরোধ করেছিলাম এসএসকেএম-কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে নিতে।’’

তৃণমূলের চিকিৎসক-নেতা না হয় একটা আবদারই করলেন। কিন্তু হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ তাতে কী ভাবে সায় দিলেন?

এসএসকেএমের নেফ্রোলজি-র প্রধান রাজেন্দ্র পাণ্ডের জবাব, ‘‘একটা কুকুরের ডায়ালিসিসের অনুরোধ এসেছিল। তাতে হয়েছেটা কী? মানুষ ও কুকুর, উভয়েই স্তন্যপায়ী গোষ্ঠীর প্রাণী। দু’জনের ডায়ালিসিস একই ধরনের মেশিনে হতে পারে।’’ তিনি আরও জানান, ‘‘আমি সেই সময় রাজ্যের বাইরে ছিলাম। কিন্তু নির্দেশ দিয়ে সব রকম টেকনিক্যাল সাপোর্ট তৈরি করিয়ে রেখেছিলাম। শেষ পর্যন্ত কোনও কারণে তা করা যায়নি।’’ কী কারণ?

এসএসকেএমের অধ্যক্ষ প্রদীপ মিত্রের বক্তব্য, ‘‘গত ১০ জুন একটি কুকুরকে এসএসকেএমে ভর্তি করে ডায়ালিসিস করার জন্য রাজেন্দ্র পাণ্ডে এসএমএস করে আমাকে অনুরোধ করেন। আমাকে উনি জানিয়েছিলেন, এটা চ্যালেঞ্জিং কেস, ওঁরা টেকনিশিয়ানদের রেডি করে রেখেছেন, শুধু আমার অনুমতি চাই। নির্মল মাজি-ও সুপারিশ করে ফোন করেন।’’

সেই মতো তিনি লিখিত অনুমোদন দিয়ে দিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন প্রদীপবাবু। অধ্যক্ষের নির্দেশ নেফ্রোলজি’তে পৌঁছে যায়। তাতে লেখা ছিল— অ্যান আনআইডেন্টিফায়েড ডগ অ্যাডভাইসড ফর হিমোডায়ালিসিস।

ওই চিরকুট হাতে পেয়েই চমকে উঠেছিলেন বিভাগের সিনিয়র ডাক্তারেরা। হাসপাতাল-সূত্রের খবর, বিভাগীয় প্রধান রাজেন্দ্র পাণ্ডে সেই সময়েই ওঁদের ফোন করে বলেন কুকুরের ডায়ালিসিস শুরু করে দিতে।

স্তম্ভিত চিকিৎসকদের একাংশ তখন প্রদীপবাবুকে ফোন করে আপত্তির কথা জানান। প্রদীপবাবু বলেন, ‘‘আমি ওঁদের বলেছিলাম, আপত্তির কারণগুলো লিখিত জানিয়ে দিন। তা হলেই হবে। সেই মতো ওঁরা লিখে দেন।’’

নেফ্রোলজি’র চিকিৎসকেরা কীসের ভিত্তিতে আপত্তি করেছিলেন?

ওঁদের বক্তব্য ছিল, তাঁরা মানুষের ডায়ালিসিস করতে শিখেছেন। কুকুর বা অন্য জীবজন্তুর ডায়ালিসিস করতে তাঁরা অভ্যস্ত বা প্রশিক্ষিত নন। উপরন্তু কুকুরের ডায়ালিসিসে চ্যানেল কী ভাবে হবে, কতটা জল বা ওষুধ দিতে হবে, এ সব তাঁদের জানা নেই। ফলে এসএসকেএমে ডায়ালিসিস করলে কুকুরটির প্রাণসংশয় হতে পারে।

শুধু এটুকুই? এসএসকেএমের নেফ্রোলজি’তে সে দিন ভিজিটিং চিকিৎসক ছিলেন অর্পিতা রায়চৌধুরী। তিনি তাঁর নোটে লিখেছেন, ‘‘কুকুরের মতো জন্তুর দেহ থেকে রক্তের মাধ্যমে ডায়ালিসিস যন্ত্রে এমন ভাইরাস চলে আসতে পারে, যা থেকে পরে মানুষেরা মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। ফলে এটা সম্ভব নয়।’’

এবং সেই নোট পেয়েই শেষমেশ অনুমতি প্রত্যাহার করে নেন অধ্যক্ষ। কিন্তু নেফ্রোলজি-র ভিজিটিং চিকিৎসক যে কারণটির উল্লেখ করেছেন, প্রদীপবাবু-রাজেন্দ্রবাবু-নির্মলবাবুর কি তা জানা ছিল না?

নেফ্রোলজি-র এক অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণ, ‘‘নির্মলবাবু তো আদতে রাজনীতিক। একটা ডাক্তারি ডিগ্রি রয়েছে মাত্র। অন্য দিকে রাজেনবাবু আর প্রদীপবাবু চাকরি বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন। চিকিৎসা-বিধি মানেননি।’’

এমতাবস্থায় তিন চিকিৎসকেরই ডাক্তারি রেজিস্ট্রেশন বাতিল হওয়া উচিত বলে ওঁরা অনেকে মনে করছেন। ‘‘নেফ্রোলজি-র ভিজিটিং চিকিৎসক আমাদের সম্মান বাঁচিয়ে দিলেন। বড় বিপর্যয় থেকে হাসপাতাল বাঁচল।’’— মন্তব্য এক জনের। স্বাস্থ্য ভবন কী বলছে?

রাজ্যের স্বাস্থ্য-প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘নির্মলের কথা নির্মলকেই জিজ্ঞাসা করুন।’’ বৃত্তান্ত শুনে স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া, ‘‘উরি ব্বাবা! কী কাণ্ড! আমি কিছু বলছি না।’’

তবে বামফ্রন্ট জমানার স্বাস্থ্যমন্ত্রী তথা বর্তমানে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, ‘‘নির্মলবাবু তো মানুষের ডাক্তার ছিলেন শুনেছি। মানুষের ডাক্তারদের কুকুরের ডাক্তারি না করাই ভাল। এসএসকেএমে যে শুধু মানুষের চিকিৎসা হয়, সেটা বোধহয় উনি ভুলে গিয়েছেন।’’ যদিও নির্মলবাবুর ঘোষণা, ‘‘আমরা ক’দিনের মধ্যে পশু হাসপাতালে ডায়ালিসিস মেশিন বসাব। যাতে কোনও কুকুর-বেড়াল কষ্ট না-পায়। সাপেদের জন্যও একটা হাসপাতাল করার কথা ভাবছি।’’ রাজেন্দ্রবাবুরও দাবি, তিনি কোনও ভুল করেননি। কিন্তু মানুষের হাসপাতালে কি পশুর অস্ত্রোপচার হয়?

রাজেন্দ্রবাবুর ভাবলেশহীন প্রতিক্রিয়া, ‘‘না হওয়ার তো কিছু নেই।’’ এর পরেও কি স্বাস্থ্য-প্রশাসন ওঁদের বিরুদ্ধে হাত গুটিয়ে থাকবে?

স্বাস্থ্যভবনের এক কর্তার জবাব, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর অতি ঘনিষ্ঠ ওই চিকিৎসক। তাঁর উপরে মুখ্যমন্ত্রীর অগাধ আস্থা। এসএসকেএম ছাড়াও শম্ভুনাথ পণ্ডিতে ডায়ালিসিস ইউনিটের অতিরিক্ত দায়িত্ব বর্তেছে রাজেন্দ্র পাণ্ডের উপরে।’’

এমতাবস্থায় ওঁকে শাস্তি দেওয়ার মতো বুকের পাটা কার আছে,পাল্টা সেই প্রশ্নই তুলেছেন স্বাস্থ্যভবনের সূত্রটি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE