Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ধন্যবাদ দিয়ে চিরকুট দিচ্ছেন ‘কাজের দিদিরা’

বাড়ির পরিচারিকার কথাটা শুনে তাই হকচকিয়েই গিয়েছিলেন নিউ গড়িয়ার বাসিন্দা সৌমিক দত্ত। বছর দু’য়েকের পুরনো ‘কাজের দিদি’ মায়ারানি শেখ এ বার পুজোর ঠিক পরেই একগাল হেসে ‘বাবু’র হাতে রীতিমতো ছাপার অক্ষরে শংসাপত্র ধরিয়ে দিয়েছেন। 

এ ভাবেই ধন্যবাদ জানিয়েছেন পরিচারিকারা

এ ভাবেই ধন্যবাদ জানিয়েছেন পরিচারিকারা

ঋজু বসু
শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০১৮ ০২:২৪
Share: Save:

খানিকটা উলটপুরাণই বলা যায়! বাড়ির পরিচারিকার কথাটা শুনে তাই হকচকিয়েই গিয়েছিলেন নিউ গড়িয়ার বাসিন্দা সৌমিক দত্ত। বছর দু’য়েকের পুরনো ‘কাজের দিদি’ মায়ারানি শেখ এ বার পুজোর ঠিক পরেই একগাল হেসে ‘বাবু’র হাতে রীতিমতো ছাপার অক্ষরে শংসাপত্র ধরিয়ে দিয়েছেন।
বারাসতের কাছে হৃদয়পুরের একটি পরিবারের গিন্নি মামণি দাসের জন্যও এ এক মধুর বিস্ময়! তিনি বলছেন, ‘‘এমনটা কখনও হয়নি।’’ এ বার পুজোয় এক মাসের বোনাস মাইনে দিতেই ছ’বছরের পুরনো কাজের মেয়ে দেবযানী ঘড়াই এক গাল হেসে ‘বৌদি’র হাতে একটা চিলতে কাগজ ধরিয়ে দিয়েছেন। অনেকটা হ্যান্ডবিলের ধাঁচে ছাপানো কাগজ। ‘পশ্চিমবঙ্গ গৃহ পরিচারিকা সমিতি’র নামে ছাপানো সেই কাগজে ‘বোনাস প্রদান’-এর জন্য ধন্যবাদ জানানো হয়েছে। সেই সঙ্গে বলা হয়েছে, পরিচারিকাদের পেশাটি যাতে ‘ভদ্র ও সম্মানিত’ গোত্রের মর্যাদা পায়, সেই লক্ষ্যেই তাঁরা লড়ে যাচ্ছেন। নিয়োগকর্তা ও পরিচারিকার মধ্যে সুস্থ সম্পর্ক তৈরিতেই তাঁরা অঙ্গীকারবদ্ধ।
কয়েক মাস আগেই ট্রেড ইউনিয়নের স্বীকৃতি পেয়েছে হাজার ছ’য়েক সদস্যের গৃহ পরিচারিকা সমিতি। এখন গুজরাত, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ুর মতো কয়েকটি রাজ্যের আদলে ন্যূনতম মজুরি বেঁধে দেওয়ার লক্ষ্যে তাঁরা লড়ছেন। ইউনিয়ন, নিয়োগকর্তা, প্রশাসনকে নিয়ে গৃহশ্রমিক কল্যাণ পর্ষদ গড়ার লক্ষ্যেও শ্রম দফতরে দাবিদাওয়া পেশ করা হয়েছে। কিন্তু তার আগেই পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নতির চেষ্টায় আগুয়ান পরিচারিকাদের ইউনিয়ন। এ বার পুজোয় এক মাসের বোনাস মাইনের সঙ্গেই এমন ধন্যবাদ সূচক শংসাপত্র চালু করেছেন তাঁরা। হৃদয়পুরের মামণিদেবী বা মঞ্জুলতা ভকতের হাতে শংসাপত্র ধরানোর পরে সংশ্লিষ্ট পরিচারিকা এক সঙ্গে নিজস্বীও তুলেছেন হাসিমুখে। ইউনিয়নের সদস্যদের অনেকেরই স্মার্টফোনে এমন নিজস্বী পরস্পরকে পাঠানো চলছে।
তবে ইউনিয়নের রাজ্য কমিটির সম্পাদক অনিতা মিস্ত্রি অবশ্য কাজের বাড়িকে শংসাপত্র দেওয়া হচ্ছে, বিষয়টিকে ঠিক এ ভাবে দেখতে নারাজ। তাঁর কথায়, ‘‘একটা সামান্য পাতলা কাগজে ছাপানো ক’টা কথা! যাঁরা কাজ করছেন, আর যাঁরা লোক রাখছেন— দু’পক্ষেরই আর একটু দায়িত্ব বাড়িয়ে দেবে এই কাগজ।’’ যে তল্লাটে ইউনিয়নের সংগঠন বেশি মজবুত, উত্তর শহরতলির সেই বারাসত এলাকা ও প্রধানত ঢাকুরিয়া, কালিকাপুর, আনন্দপুর, পঞ্চসায়র, নিউ গড়িয়া অঞ্চলে বোনাসের পরে এই কাগজ দিয়েছেন পরিচারিকারা। হাজারখানেক ‘শংসাপত্র’ বিলি হয়েছে। এমনিতে কলকাতার বেশির ভাগ পরিবারেই পুজোর মাসে পরিচারিকাকে এক মাসের মাইনে বোনাস দেওয়া এখন দস্তুর। কেউ কেউ ইদের মাসে বোনাস দিয়ে থাকেন। ইউনিয়নের সঙ্গে জড়িত পরিচারিকাদের একাংশ বলছেন, কোনও কোনও বাড়িতে বোনাসের বদলে নতুন পোশাক দেওয়া দস্তুর। কিছু বাড়িতে দুটোই দেওয়া হয়। পরিচারিকা ও কাজের বাড়ির মধ্যে বোঝাপড়ায় বিষয়টা স্থির হয়।
তবে কারও কারও মতে, পরিচারিকার সঙ্গে সম্পর্কটা এখনও অনেক বাড়িতেই ততটা পোশাকি বা বাঁধাধরা কাজের নয়। আত্মীয়ের মতোই নানা কাজে পরিচারিকারা হাত লাগান। তাঁদের বিপদে-আপদেও নিয়োগকর্তারা পাশে থাকেন। তাই বোনাসের বদলে ধন্যবাদ দিয়ে কাগজ ধরানোটাই সব নয়। পরিচারিকাদের ইউনিয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারও কারও অভিজ্ঞতা বলছে, কিছু ক্ষেত্রে পরিচারিকাদের উপরে বোঝাটা খানিক সামন্ততান্ত্রিক ঢঙেই চাপানো হয়। যার বদল দরকার। তার আগে এই ধন্যবাদ-পর্ব সুভদ্র ভঙ্গিতে পরিচারিকাদের অধিকারকেই খানিকটা প্রতিষ্ঠা দেবে।
নৃত্যশিল্পী ও অভিনেত্রী মমতাশঙ্কর যেমন বলছেন, ‘‘এই কাগজে-কলমে ধন্যবাদটা এক ধরনের বাড়তি প্রাপ্তি। তবে আসল হল, দু’পক্ষের বিশ্বাস, শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতাবোধ। ভালবাসাই ভালবাসাকে টানে! কাজের মেয়ে দেশের বাড়ির ফল, মাছ এনে আমায় দিয়েছে। মুগ্ধ হয়েছি। আবার কারও বাচ্চাকে নিজের মতো আদরযত্ন করেও তাদের ব্যবহারে পরে কষ্ট পেতে হয়েছে। কাজের লোকেদের উপরে নানা ভাবে আমাদের নির্ভর করতে হয়। দু’তরফের সহানুভূতি, প্রাণের ছোঁয়াটা অটুট থাকুক। আর কিছু চাই না!’’
আর পরিচালক শেখর দাশের কথায়, ‘‘এখনকার শহুরে পরিবার হয়তো ‘খারিজ’-এর গল্পের তুলনায় অনেকটাই মানবিক হয়েছে, তবু তা যথেষ্ট নয়। ‘নয়নচাঁপার দিনরাত্রি’ ছবিটা করার সময়ে বুঝেছি, কলকাতায় দূর থেকে আসা পরিচারিকাদের জীবন মুম্বইয়ের ‘বাই’-দের তুলনায় ঢের কঠিন। পরিচারিকাদের তরফে এই ধন্যবাদের চেষ্টা বাড়ির কর্তাদের কিছুটা দায়বদ্ধ করবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

House Maid Maid Servant Community
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE