Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
West Bengal

স্রেফ ১২ কোটিতেই ভাঙড়ে বাজিমাত সরকারের!

মঙ্গলবার হাসতে হাসতে তাঁর উত্তর, “আপনি আজকে ফসল দেখছেন। জমি তৈরি হয়েছিল পঞ্চায়েত ভোটের ঠিক আগেই। আর চারা বেরিয়েছিল অলীক চক্রবর্তী গ্রেফতার হওয়ার পাঁচ দিন আগে।”

ভাঙড় আন্দোলনের শীর্ষনেতা অলীক চক্রবর্তী।- ফাইল চিত্র।

ভাঙড় আন্দোলনের শীর্ষনেতা অলীক চক্রবর্তী।- ফাইল চিত্র।

সিজার মণ্ডল
ভাঙড় শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০১৮ ১৮:৫৭
Share: Save:

দেড় বছরের বেশি সময় ভাঙড়ে দাঁত ফোটাতে পারেনি রাজ্য সরকার। শুধু রাজ্য প্রশাসন কেন, নিজের খাস তালুকে হালে পানি পাননি আরাবুল ইসলামের মতো ধুরন্ধর নেতাও।

সেই ভাঙড়ে কী এমন ম্যাজিক হল, যাতে সেই অনড় আন্দোলনকারীদের সম্মতিতেই মঙ্গলবার প্রায় পরিত্যক্ত চেহারা নেওয়া প্রস্তাবিত পাওয়ার গ্রিডে ফের কাজ শুরু হল? প্রশ্নটা করেছিলাম রাজ্য সরকারের এক আমলাকে।

মঙ্গলবার হাসতে হাসতে তাঁর উত্তর, “আপনি আজকে ফসল দেখছেন। জমি তৈরি হয়েছিল পঞ্চায়েত ভোটের ঠিক আগেই। আর চারা বেরিয়েছিল অলীক চক্রবর্তী গ্রেফতার হওয়ার পাঁচ দিন আগে।”

হেঁয়ালির উত্তর মিলল গোটা অপারেশনে আগাগোড়া সক্রিয় থাকা এক পুলিশ কর্তার কথায়। তিনি বলেন, মে মাসে ভুবনেশ্বরে গ্রেফতার হওয়ার আগে দু’বার চিকিৎসা করাতে এবং দলীয় কিছু নেতার সঙ্গে কথা বলতে ভাঙড়ের বাইরে গিয়েছিলেন অলীক চক্রবর্তী। কিন্তু প্রতি বারেই পুলিশ খবর পেয়েছে অনেক পরে। তাই অধরা থেকে গিয়েছিলেন ভাঙড় আন্দোলনের শীর্ষনেতা।

সেই ব্যর্থতা মেনে নিয়েই ত্রিমুখী কৌশল নেয় প্রশাসন। একদিকে আন্দোলনকারীদের ক্রমাগত অর্থের প্রলোভন দেওয়া, সঙ্গে পুলিশি চাপ বাড়ানো। আর তার মধ্যেই পঞ্চায়েত নির্বাচনের ঠিক আগে, গণ্ডগোলের জেরে আরাবুল ইসলামকে গ্রেফতার করে আন্দোলনকারীদের একটা বার্তা দেওয়ার চেষ্টা।

মঙ্গলবার প্রশাসনিক কর্তাদের উপস্থিতিতে শুরু হল ভাঙড়ে বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ।- নিজস্ব চিত্র।

এক পুলিশ কর্তা বলেন, ভোট মেটার পরেই খবর এল অলীককে দেখতে এক চিকিৎসক আসছেন। অর্থ বা চাপ— যে কারণেই হোক না কেন, সেই চিকিৎসকের সমস্ত খুঁটিনাটি পৌঁছে যায় পুলিশের কাছে। জ্যাংড়ার একটি নার্সিংহোমের সঙ্গে যুক্ত সেই চিকিৎসক কবে কখন কোন গাড়ি চড়ে মাছিভাঙা গ্রামে অলীক চক্রবর্তীকে দেখতে যাচ্ছেন তা পুঙ্খনাপুঙ্খ জানত পুলিশ। দক্ষিণ ২৪ পরগনার এক পুলিশ কর্তা বলেন, “এর আগের বার ওই চিকিৎসকের কাছেই চিকিৎসা করিয়ে ভুবনেশ্বরের হাসপাতালে গিয়েছিলেন অলীক। খরচ হয়েছিল প্রায় ৭০ হাজার টাকা। সেই টাকা কমিটিই দিয়েছিল।”

অলীক চক্রবর্তী যে ক’দিনের মধ্যেই ফের চিকিৎসা করাতে বাইরে যাবেন, তা আগেভাগেই জানত পুলিশ। সতর্কতা হিসাবে, জেলা পুলিশের পাশাপাশি কলকাতা পুলিশের এসটিএফ এবং সিআইডি সম্ভাব্য কয়েকটি ভিনরাজ্যের হাসপাতালে আগেই ঘাঁটি গাড়ে।

আরও পড়ুন- অশান্তি অতীত, বিদ্যুৎ সাবস্টেশনের কাজ শুরু হয়ে গেল ভাঙড়ে​

আরও পড়ুন- দু’পক্ষের সম্মতিতে ভাঙড়ে জটমুক্তি​

কিন্তু খুব অপ্রত্যাশিত ভাবেই জেলা পুলিশের কাছে চলে আসে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। এক তদন্তকারী বলেন, “অলীক ভাঙড় ছাড়ার আগে এক সহযোগীর মাধ্যমে ৩৯০০ টাকা দিয়ে একটি মোবাইল কেনেন। সিমকার্ড নেওয়া হয় অলীকের সংগঠনের এক সহকর্মী শুক্লা ভুঁইমালির নামে।” এই সমস্ত তথ্য, এমনকি মোবাইলের আইইএমআই নম্বরও পৌঁছে যায় পুলিশের কাছে। তাই জেলা পুলিশকে খুব একটা কাঠখড় পোড়াতে হয়নি অলীককে গ্রেফতার করতে।

আর সেখানেই দুঁদে পুলিশ কর্তারা বুঝে যান, কমিটির অন্দর মহলেই ভাঙন ধরেছে। সূত্রে খবর, অলীক চক্রবর্তী গ্রেফতার হওয়ার পর পুলিশ কর্তারা তাঁর কাছেও লুকোননি— কী ভাবে তাঁকে গ্রেফতার করা হল। এক পুলিশ কর্তার কথায়, ওই সময় অলীক চক্রবর্তীর চিকিৎসা জরুরি ছিল। তাঁকে একদিকে যেমন চিকিৎসার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, পাশাপাশি, হেফাজতে নিয়ে তাঁকে প্রথমেই আলোচনার প্রস্তাব দেওয়া হয়।

সূত্রের খবর, ভাঙড় থানাতে অলীক চক্রবর্তীকে নিয়ে এসে, তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ চার সহযোগী— মীর্জা হাসান, অলি মহম্মদ, সাজারুল ইসলাম এবং মোশারফ হোসেনের সঙ্গে সামনা সামনি কথা বলতে দেওয়া হয়। প্রশাসন এক দিকে আলোচনার দরজা খোলা রাখে, অন্য দিকে রাজি না হলে যে আইনি পদক্ষেপ আরও জোরালো হবে, সেই বার্তা স্পষ্ট ভাবে দেয়। আর তাতেই বরফ গলে।

প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিল প্রশাসন। ইউএপিএ-তে অভিযুক্ত থাকার পরও, আলোচনার স্বার্থে অলীক চক্রবর্তীর জামিনে দ্রুত মুক্তি নিয়ে আপত্তি করেনি তারা। কলকাতার অন্যতম সেরা বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসারও বন্দোবস্ত হয়। জামিনে মুক্ত হওয়ার পর, অলীক চক্রবর্তীর নতুন ঠিকানা এখন নিউটাউনের একটি নামী আবাসন।

এক আমলার কথায়, যে কোনও আন্দোলন থেকে সরে আসার জন্য আন্দোলনকারীদের দরকার হয় একটা ‘এসকেপ রুট’। ‘পাওয়ার গ্রিড’-এর বদলে ‘সাব স্টেশন’— সেই রাস্তাকেই মসৃণ করে।

মঙ্গলবার পাওয়ার গ্রিড বিরোধী জমি জীবিকা বাস্তুতন্ত্র বাঁচাও কমিটির সম্পাদক মীর্জা হাসানের দাবি, “এটা ভাঙড়ের আন্দোলনের জয়। আমাদের আন্দোলনের ফলেই সরকার পাওয়ার গ্রিড তৈরির সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে আঞ্চলিক সাব স্টেশন তৈরিতে সম্মত হয়েছে। গত দেড় বছরে এখানকার মানুষের যে ক্ষতি হয়েছে, তার জন্য ১২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করেছে কমিটি।”

প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারা প্রকাশ্যে এ প্রসঙ্গে কিছু না বললেও, আড়ালে তাঁদের দাবি, ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে দু’জন আন্দোলনকারীর মৃত্যুর পর, ভাঙড়ের এক নেতার মাধ্যমে ঠিক এই প্রস্তাবই দেওয়া হয়েছিল আন্দোলনকারীদের কাছে, যা আজ তাঁরা মেনে নিয়েছেন। তখন ক্ষতিপূরণের ব্যাপারে আরও নমনীয় ছিল সরকার। তাই প্রশাসনের কর্তারা এটাকে কমিটির জয় বলে মানতে নারাজ। এই আমলার দাবি যে খুব ভিত্তিহীন নয়, তা মঙ্গলবার বোঝা গেল কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দার কথায়। তাঁদের একজন বলেন, কাইজার তো সে দিন এই কথাই বলেছিলেন।

সোমবারই প্রশাসনের কাছ থেকে আট লাখ টাকার ক্ষতিপূরণের চেক নিয়েছেন ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত আলমগিরের দাদা মোস্তাকিন মোল্লা। তিনি কতটা খুশি? প্রশ্নের উত্তরে তাঁর জবাব, “কমিটির সবাই মিলে যা করেছে তা তো মানতেই হবে।” কমিটির সবাই কি এই চুক্তিতে সহমত? প্রশ্নটা আসে কারণ, চুক্তির পর রবিবারের বিজয়মিছিলে দেখা যায়নি আজিম মোল্লা বা আবুলের মতো প্রথম সারির অনেক নেতাকেই। মঙ্গলবার বিদ্যুত্ প্রকল্পের সামনে কমিটির নেতাদের ভিড়েও এঁদের দেখা যায়নি।

মোস্তাকিনের মতো রাখঢাক নেই মাছিভাঙার বৃদ্ধ সিদ্দিক মোল্লার। গত দেড় বছরে আন্দোলনের যে কোনও মুহূর্তে এই বৃদ্ধকে সবসময়ে সামনে থেকে দেখেছি। যদিও এই বৃদ্ধের এক ছটাকও জমি নেই। তাঁর সাফ কথা, “কেউ খুশি নয়। গলা ধাক্কা দিয়ে যদি কেউ আপনাকে দশটা টাকা দেয়, তা হলে কি আপনার ভাল লাগবে?”

মঙ্গলবার যখন জেলার অতিরিক্ত জেলাশাসক এবং পুলিশ কর্তাদের উপস্থিতিতে পাওয়ার গ্রিড কর্তৃপক্ষ নির্মীয়মাণ সাব স্টেশনে ঢোকেন, তখন সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন খামারআইটের শেখ জয়নালও। তিনি বলেন, “আমরা তো পুরো প্রজেক্টেরই বিরুদ্ধে ছিলাম। এখন নেতারা যদি এটা মেনে নেন, আমরা আর কী করব?”

আর সেই দ্বিধা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে মানুষের মধ্যে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE