Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪
West Bengal

রাজ্য নেতৃত্বের নির্দেশ অগ্রাহ্য, পছন্দের প্রার্থীকেই পঞ্চায়েত প্রধান করলেন নদিয়ার বিধায়ক

নদীয়ার আড়ংঘাটা পঞ্চায়েতে এই ঘটনা ঘটল শনিবার। ওই পঞ্চায়েতের প্রধান কাকে করা হবে, তা নিয়ে স্থানীয় তৃণমূলের দু’টি গোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ চলছিল বেশ কিছু দিন ধরে।

অলংকরণ: শৌভিক দেবনাথ।

অলংকরণ: শৌভিক দেবনাথ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১৮:৫৪
Share: Save:

তৃণমূলের রাজ্য নেতৃত্বের নির্দেশ উপেক্ষা করে রানাঘাট উত্তর-পূর্বের বিধায়ক সমীর পোদ্দার তাঁর পছন্দের নেত্রীকে বসিয়ে দিলেন পঞ্চায়েত প্রধানের পদে। স্থানীয় তৃণমূল কর্মীদের একাংশের অভিযোগ, রমা লস্কর নামের ওই মহিলাকে প্রধান করার জন্য তাঁর স্বামী শান্তনু লস্কর ওরফে টিটু এলাকায় রীতিমতো সন্ত্রাসের আবহ কায়েম করেছিলেন। রাজ্য নেতৃত্বের কাছ থেকে আসা খাম খোলা হয়েছিল যেখানে, সেই আড়ংঘাটা পার্টি অফিস টিটুর দলবল এমন ভাবে ঘিরে রেখেছিল যে, রাজ্য নেতৃত্বের নির্দেশ উপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনও পথ খোলা ছিল না তৃণমূলের অঞ্চল সভাপতির সামনে।স্থানীয় তৃণমূল কর্মীদের একাংশই এমনটা জানাচ্ছেন। তবে তৃণমূলের আড়ংঘাটা অঞ্চল কমিটির সভাপতি শিশির সেন চাপের মুখে নতি স্বীকার করার কথা অস্বীকার করেছেন।

নদিয়ার আড়ংঘাটা পঞ্চায়েতে এই ঘটনা ঘটল শনিবার। ওই পঞ্চায়েতের প্রধান কাকে করা হবে, তা নিয়ে স্থানীয় তৃণমূলের দু’টি গোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ চলছিল বেশ কিছু দিন ধরে। স্থানীয় বিধায়ক সমীর পোদ্দারের পছন্দের প্রার্থী ছিলেন টিটুর স্ত্রী রমা লস্কর। বিরোধী গোষ্ঠী সমর্থন করছিল ’৯৮ সালের পঞ্চায়েত প্রধান তারক বিশ্বাসকে। স্থানীয় তৃণমূলের একাংশের অভিযোগ ছিল, রমাদেবীকে প্রধানের পদে বসানোর জন্য টিটু এলাকায় সন্ত্রাস চালাচ্ছেন। আর তাতে মদত দিচ্ছেন বিধায়ক সমীর পোদ্দার। এ ব্যাপারে স্থানীয় তৃণমূলের তরফে রাজ্য নেতৃত্বের কাছে নালিশ জানানো হয়েছিল। তৃণমূলের নদিয়া জেলার পর্যবেক্ষক পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে মধ্যস্থতার দাবি জানানো হয়েছিল। অভিযোগ পেয়ে নেতৃত্ব পদক্ষেপও করে। বিধায়ক সমীর পোদ্দারের হাতে পুরো দায়িত্ব ছেড়ে না দিয়ে রানাঘাট উত্তর পশ্চিমের বিধায়ক তথা নদিয়া জেলা তৃণমূলের অন্যতম শীর্ষনেতা শঙ্কর সিংহকে বিষয়টির মীমাংসা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। শঙ্কর আড়ংঘাটার তৃণমূল নেতৃত্ব ও পঞ্চায়েত সদস্যদের সঙ্গে বৈঠকও করেন। তার পরে তিনি রাজ্য নেতৃত্বকে রিপোর্ট পাঠিয়ে দেন বলে তৃণমূল সূত্রের খবর।

শনিবার ছিল বোর্ড গঠনের তারিখ। আড়ংঘাটা পঞ্চায়েতের প্রধান কে হবেন, মুখবন্ধ খামে রাজ্য নেতৃত্ব সেই নির্দেশ পাঠান। বিধায়ক সমীর পোদ্দার খাম পৌঁছে দেন আড়ংঘাটা অঞ্চল তৃণমূল সভাপতি শিশির সেনের হাতে। আড়ংঘাটা তৃণমূল অফিসে বসে সেই খাম খোলা হয় বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে। রাজ্য নেতৃত্বের নির্দেশে লেখা ছিল, রমা লস্কর বা তারক বিশ্বাস, কাউকেই প্রধান করা যাবে না। প্রধান হিসেবে বেছে নিতে হবে তৃতীয় কাউকে। কিন্তু সেই নির্দেশ শেষ পর্যন্ত মানা হয়নি। রমা লস্করকেই প্রধান করার সিদ্ধান্ত নেওযা হয় তৃণমূলের বৈঠকে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বোর্ড গঠনের সময়ে রমাই প্রধান নির্বাচিক হন। স্থানীয় তৃণমূল কর্মীদের একাংশ জানালেন, টিটুর দলবল এমনভাবে ঘিরে রেখেছিল তৃণমূল অফিস এবং এমন সন্ত্রাসের পরিবেশ কায়েম করা হয়েছিল যে, অঞ্চল তৃণমূলের বৈঠকে রমা লস্করকে প্রধান হিসেবে মেনে নেওয়া ছাড়া অন্য কোনও পথ খোলা ছিল না স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের সামনে।

অঞ্চল তৃণমূলের সভাপতি শিশির সেন অবশ্য সন্ত্রাসের পরিবেশের অভিযোগ মানেননি। তিনি বলেন, ‘‘কোনও সন্ত্রাস ছিল না, আমার উপরে কোনও চাপ ছিল না। নিজেদের ইচ্ছেতেই আমরা রমা লস্করকে প্রধান পদে মনোনীত করার সিদ্ধান্ত নিই।’’ কিন্তু ‘নিজেদের ইচ্ছে’তে রমা লস্করকে প্রধান করলেন কীভাবে? রাজ্য নেতৃত্ব তো স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছিলেন, রমাকে প্রধান করা যাবে না। শিশির সেন বললেন, ‘‘ হ্যাঁ, নির্দেশ তেমনই এসেছিল। কিন্তু এখানে সবাই রমা লস্করকেই চাইছিলেন। তাই সর্বসম্মতিক্রমে আমরা তাঁকেই প্রধান করার সিদ্ধান্ত নিই।’’ টিটুর বিরোধীরা অবশ্য বলছেন, শিশির সেনের আর কিছু বলার নেই। চাপের মুখে রাজ্য নেতৃত্বের নির্দেশ উপেক্ষা করতে বাধ্য হয়েছেন, এমনটা স্বীকার করলে শিশির সেনেরও বিপদ হবে, দাবি তৃণমূলের ওই অংশের।

আরও পড়ুন- বুধবার বাংলা বন্‌ধের ডাক বিজেপির, বন্‌ধ মোকাবিলায় প্রশাসনকে নির্দেশ মুখ্যমন্ত্রীর​

আরও পড়ুন- দুই শিক্ষকের কথায় প্রভাবিত হয়েই কি ঝাঁপিয়েছিল পুলিশ? নীরব এসপি

নদিয়ার আড়ংঘাটা গ্রাম পঞ্চায়েতের ২০টি আসনের মধ্যে ১৭টিতে জয়ী হয়েছে তৃণমূল। গোটা তিনেক আসনে আবার জয় এসেছে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। এই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী প্রার্থীদেরই এক জন রমা লস্কর। স্বামী টিটু লস্করের দাপটেই ১২৭ নম্বর বুথে রমার বিরুদ্ধে কেউ প্রার্থী হতে পারেননি, বলছেন এলাকার তৃণমূল কর্মীদেরই একাংশ। বিষয়টি নিয়ে খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছিল রানাঘাট উত্তর-পূর্ব বিধানসভা কেন্দ্র থেকে। ওই সময় দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে স্থানীয় বিধায়ক ধমক খেয়েছিলেন বলেও জানিয়েছেন স্থানীয় তৃণমূলের একাংশ। কিন্তু তার পরেও যে টিটুর দাপট অটুট গোটা এলাকায়, এ দিনও তার প্রমাণ মিলল। টিটু লস্করের স্ত্রী রমা গত বারও পঞ্চায়েত ভোটে জয়ী হয়েছিলেন। তবে প্রধান ছিলেন না। এ বার রমাকে প্রধান করার লক্ষ্যে টিটু কোমর বেঁধে নেমেছিলেন, বলছেন স্থানীয় তৃণমূলের একাংশ।

শান্তনু লস্কর ওরফে টিটুর বিরুদ্ধে অভিযোগের বহর বিস্তর। কেউই প্রকাশ্যে মুখ খুলতে চান না। তবে নাম গোপন রাখার শর্তে অনেকেই মুখ খোলেন। কেউ বলছেন, টিটু লস্করের পরিচিতিই হল ‘গুন্ডা’ হিসেবে। কেউ বলছেন, এক সময়ে সিপিএমের ছাতার তলায় থেকে ‘গুন্ডামি’ করতেন টিটু। ১৯৯৮ সালে আড়ংঘাটায় তৃণমূল অফিসে বোমা হামলার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে কংগ্রেস এবং তৃণমূলের একাধিক কর্মীকে খুন করারও। ২০০২ সালে আড়ংঘাটা গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্য রতন চক্রবর্তীকে গুলি করা এবং নদিয়া জেলা তৃণমূলের এককালের গুরুত্বপূর্ণ নেতা সমীর নাগের হত্যাকারীদের আশ্রয় দেওয়া— টিটুর ‘কীর্তি’ অনেক রকম, শোনা যাচ্ছে স্থানীয় সূত্রেই। এ ছাড়া আর্থিক অনিয়ম, পূর্ত দফতরের জমি দখল করে বাড়ি করা— টিটু লস্করের বিরুদ্ধে এমন গুচ্ছ গুচ্ছ অভিযোগ নিয়ে ফিসফাস চলছে আড়ংঘাটার তৃণমূল কর্মীদের মধ্যে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE