Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

আজ স্বাধীনতা, উপহার গায়ে তুললেন মনসুর

এত দিনে ওঁরা ‘দেশ’ পেলেন। পাশের গ্রাম থেকে সাদা-কালো টিভি, ব্যাটারি ভাড়া করে এনেছিলেন ওঁরা। দু’দেশের আধ লক্ষ পরিচয়হীন মানুষ অপেক্ষায় ছিলেন বহু কাঙ্ক্ষিত এক মুহূর্তের। শনিবারই স্থলসীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষর হচ্ছে ধরে নিয়ে সকাল থেকে পতাকা উত্তোলন এবং উৎসবের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছিল। বিকেলে টিভিতে ঢাকায় শেখ হাসিনা, নরেন্দ্র মোদী ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে চুক্তি স্বাক্ষর দেখে উৎসবে মেতে এঠে ছিটমহল।

মনসুর আলি

মনসুর আলি

অরিন্দম সাহা
কোচবিহার শেষ আপডেট: ০৭ জুন ২০১৫ ০৩:৪৯
Share: Save:

এত দিনে ওঁরা ‘দেশ’ পেলেন।

পাশের গ্রাম থেকে সাদা-কালো টিভি, ব্যাটারি ভাড়া করে এনেছিলেন ওঁরা। দু’দেশের আধ লক্ষ পরিচয়হীন মানুষ অপেক্ষায় ছিলেন বহু কাঙ্ক্ষিত এক মুহূর্তের।

শনিবারই স্থলসীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষর হচ্ছে ধরে নিয়ে সকাল থেকে পতাকা উত্তোলন এবং উৎসবের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছিল। বিকেলে টিভিতে ঢাকায় শেখ হাসিনা, নরেন্দ্র মোদী ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে চুক্তি স্বাক্ষর দেখে উৎসবে মেতে এঠে ছিটমহল। বৃষ্টি উপেক্ষা করেই একের পর এক বেরোয় ‘আনন্দ মিছিল’।

দিনহাটার সভায় দেওয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেওয়া শাল এত দিন গায়ে দেননি পোয়াতেরকুঠির পঁচাত্তর পেরনো মনসুর আলি। চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার পরে সেই উপহারের শাল ভাঁজ ভেঙে প্রথম গায়ে তোলেন তিনি। তোবড়ানো মুখে তৃপ্তির হাসি। ওই ছিটমহলেরই সাদ্দাম হোসেন বলেন, “আমাদের নাগরিকত্ব ছিল না। ভোটার পরিচয় পত্র, রেশন কার্ড, আধার কার্ড কিছুই নেই। স্বাধীনতা কাকে বলে, তা-ই জানতাম না!’’

চুক্তি সই হতেই অনেকে তাই আনন্দে কেঁদে ফেলেন। নজর কেড়েছে ভারত-বাংলাদেশে ভাগ হয়ে যাওয়া ছিটমহলের বাসিন্দাদের পারস্পরিক সৌহার্দ্যও। বাংলাদেশের ছিটমহল মশালডাঙায় একটি বেসরকারি শিশু শিক্ষাকেন্দ্রের সামনে সকালেই ভারতের জাতীয় পতাকা তুলেছিলেন প্রবীণ আজগর আলি। পরে সেখানে ‘জনগণমন’ও গাওয়া হয়। আজগর বলেন, ‘‘ভারত-বাংলাদেশকে স্বাধীন হতে দেখেছি। ছিটমহলের স্বাধীনতাও দেখে গেলাম। জীবনের সমস্ত অপূর্ণ ইচ্ছে পূরণ হল।’’

ও পারের ছিটমহলগুলিতে যখন বাসিন্দারা তেরঙ্গা ওড়াচ্ছেন, ভারতীয় ছিটমহলের মানুষ বাড়ির সামনে তোলেন বাংলাদেশের পতাকা। পুব বাংলার সীমান্তে ঘেরা ভারতের দাসিয়ারছড়া, গারাতি, বাঁশকাটা, সাহেবগঞ্জের মতো ৩৭টি ভারতীয় ছিটমহল বাংলাদেশের পতাকায় সেজে ওঠে। ভারত সীমান্ত ঘেরা বাংলাদেশের মশালডাঙা, বাত্রিগছ, পোয়াতেরকুঠি, ছাটকুচলিবাড়িতে উড়তে থাকে তেরঙ্গা।

ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি সূত্রে জানা গিয়েছে, ভারতের ১১১টি এবং বাংলাদেশের ৫১টি— দুইয়ে মিলিয়ে ১৬২টি ছিটমহল বিনিময় হচ্ছে। তার মধ্যে বাংলাদেশের ৩৭টি ও ভারতের ৬৯টিতে জনবসতি রয়েছে। বিনিময় সম্পন্ন হলে উভয় দেশের ছিটমহলের ৫১,৪৮৪ জন নাগরিকত্ব পাবেন। আইনের শাসন, গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। এ দিন সকালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঢাকায় পৌঁছনোর আগেই বাংলাদেশের পঞ্চগড় জেলা লাগোয়া একাধিক ছিটমহলে ‘আনন্দ মিছিল’ বেরিয়ে পড়ে। দু’দেশেই অকাল হোলি। বাজি ফাটে, মিষ্টিমুখ করানো হয়। মোদী, মমতা, শেখ হাসিনার ছবির সঙ্গেই ছিটমহল বিনিময় আন্দোলনের অন্যতম নেতা দীপক সেনগুপ্তের ছবি নিয়েও মিছিল বের করা হয়।

এই উচ্ছ্বাসের মধ্যেই প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে প্রশাসন। কোচবিহার জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের মধ্যে ৩৭টি জনবসতি রয়েছে। তার সবই কোচবিহার জেলা লাগোয়া। ওই সব ছিটমহলে রাস্তাঘাট, পানীয় জল, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, স্কুল— কিছুই নেই। ওই ছিটমহলগুলি মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হলে কী কী কাজে অগ্রাধিকার দিতে হবে, তার রূপরেখা তৈরি করা হচ্ছে। ভারতীয় ছিটমহল থেকে আগ্রহীরা এ দেশের সঙ্গে যুক্ত হতে চাইলে তাঁদের পুনর্বাসন দেওয়ার জন্যও সম্ভাব্য কিছু জমি চিহ্নিত করা হয়েছে। ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি ইতিমধ্যেই ছিটমহলগুলির পরিকাঠামোর সমস্যা নিয়ে সমীক্ষা রিপোর্ট দিয়েছে জেলা প্রশাসনকে। কোচবিহার জেলাশাসক পি উল্গানাথন বলেন, “উন্নয়নে যাতে সমস্যা না হয়, তাই এই প্রস্তুতি।”

ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সহকারী সম্পাদক দীপ্তিমান সেনগুপ্ত বলেন, “এই চুক্তি ছিটমহলবাসীর কাছে আক্ষরিক অর্থেই স্বাধীনতা প্রাপ্তি। ২৬ জুন কেন্দ্রীয় ভাবে মেখলিগঞ্জের কুচলিবাড়িতে বিজয় উৎসব করা হবে।” সেখানে দু’দেশের প্রধানমন্ত্রী, এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও পদস্থ মন্ত্রীদের আমন্ত্রণ জানানো হবে বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE