Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

বিভাজন ভুলে দরজা খোলার ডাক

মুর্শিদাবাদের সালার থেকে আসা কলেজ-ছাত্রীকে কেন ধর্মীয় পরিচয়ের দরুণ ফিরিয়ে দেবেন যাদবপুরের বাড়িওয়ালা— তা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন বহু সংবেদনশীল নাগরিক।

ফেসবুকে এক ধরনের সংহতি-অভিযানে সামিল হয়েছে একটি নবজাতক গ্রুপ। ছবি: রয়টার্স।

ফেসবুকে এক ধরনের সংহতি-অভিযানে সামিল হয়েছে একটি নবজাতক গ্রুপ। ছবি: রয়টার্স।

ঋজু বসু
শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০১৮ ০১:৫৪
Share: Save:

কিছু অপমান মুখ বুজে সওয়াটাই ভবিতব্য বলে মেনে নিয়েছিলেন তনভি সুলতানা। কিন্তু ফেসবুকে নিজের যন্ত্রণা উগরে দিতেই ছবিটা পাল্টে গেল।

মুর্শিদাবাদের সালার থেকে আসা কলেজ-ছাত্রীকে কেন ধর্মীয় পরিচয়ের দরুণ ফিরিয়ে দেবেন যাদবপুরের বাড়িওয়ালা— তা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন বহু সংবেদনশীল নাগরিক। তনভির যাতে দ্রুত ঘর ভাড়া পান, তার জন্য অনেকেই আসরে নামলেন। এমনকি, বায়োকেমিস্ট্রির স্নাতক স্তরের ছাত্রীর নাম শুনে ফিরিয়ে দেওয়ার অভিযোগে বাড়িওয়ালাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন ঘর ভাড়ার সংশ্লিষ্ট ‘ব্রোকার’। সবাইকে অবাক করে বাড়িওয়ালা এ বার সবিনয় ভুলটা মানলেন। বললেন, ‘‘আমার দুই ছেলে না-বুঝে তনভিরকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। দয়া করে ওঁকে ফিরে আসতে বলুন।’’ শুক্রবার যাদবপুরের ৮বি বাসস্ট্যান্ডের কাছে সেই বাড়িতেই তনভির ফিরে এসেছেন। ‘প্রথমে ওরা বুঝতে পারেনি আমি মুসলিম’ বলে ঠিক তিন দিন আগে প্রথম বার একটি ফেসবুক গ্রুপে লিখেছিলেন মেয়েটি। তাতেই সাড়া মিলেছে। পরিণামে, বাড়িওয়ালারও ভোল বদল।

শহর কলকাতায় জাতধর্মের ফারাকের দরুণ কাউকে বাড়ি ভাড়া না দেওয়া অথবা বিক্রি না করার এই প্রবণতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেই ফেসবুকে এক ধরনের সংহতি-অভিযানে সামিল হয়েছে একটি নবজাতক গ্রুপ। কয়েক মাস আগে এ রাজ্যে মানুষে মানুষে ফাটল ধরাতে বিক্ষিপ্ত অশান্তির পটভূমিতেই এ কাজ করার কথা ভাবতে শুরু করেন কয়েক জন। তথ্যচিত্র নির্মাতা কস্তুরী বসুর মাথায় খেলে, সম্প্রীতির দরজা খোলার এই প্রবণতার নাম হোক ‘ওপেন দ্য ডোর’! এই দলের আর এক জন, সমকালীন শ্রমিক আন্দোলন নিয়ে
গবেষণারত দ্বৈপায়ন বন্দ্যোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘‘বাড়ি ভাড়া পাওয়া নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা অজস্র। যৌন হেনস্থার কথা বলতে #মিটু আন্দোলনের মতো #ওপেনদ্যডোর-এ বিভাজনের বিরুদ্ধে কথা শুরু করছি।’’

এ দেশের বেশ কয়েকটি বড় শহরেই কিন্তু রয়েছে তথাকথিত অন্য রকম লোকটিকে বাড়ি ভাড়া না দেওয়ার প্রবণতা। কোথাও আপত্তির কারণ ধর্ম, কোথাও বা খাদ্যাভ্যাস! মুম্বইয়ে কয়েক বছর আগে একটি আবাসনে আমিষাশীদের থাকার বিরুদ্ধে অলিখিত ফতোয়া জারি হয়েছিল। আবার, একলা মহিলা কিংবা অবিবাহিত
দম্পতিকে থাকতে দিতেও কারও ঘোর বাতিক। কয়েক বছর আগে দিল্লিতে হস্টেল আবাসিক বা পেয়িং গেস্ট মেয়েদের পদে পদে হয়রানির প্রতিবাদে ‘পিঁজরা তোড়’ আন্দোলন সাড়া ফেলেছিল। কিন্তু নাগরিক বাড়িওয়ালা বা বাড়ির মালিকের বিভাজন মনস্কতার শিকার হয়েও কেউ এত দিন টুঁ শব্দটি করেননি।

‘ওপেন দ্য ডোর’-এর ফেসবুক গ্রুপে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ঝুমা সেনের প্রস্তাব, বৈষম্য বিরোধী আইন তৈরির চেষ্টা হতে পারে।
সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশে একটি গোষ্ঠী সংঘর্ষের পরে এমন আইনের খসড়া হয়েছিল। রাজাবাজারের বাসিন্দা পারভেজ আলমের অভিজ্ঞতা, ‘‘এখনও বাধ্য হয়েই কমন বাথরুম, ভাড়ার ঘরে গাদাগাদি করে আছি। গড়পারে নতুন ফ্ল্যাট পেতেও সমস্যা হয়েছিল।’’ আবার দিল্লিতে ভিনধর্মী দম্পতিদের বিয়ে সমস্যা দূর করতে সক্রিয় সমাজকর্মী আসিফ ইকবাল অন্য ধরনের অভিজ্ঞতার কথা বলছেন। ‘‘কয়েকটি আবাসনে অ-মুসলিমদের থাকতে দিতেও ছুতমার্গ দেখেছি।’’

দরজা খোলার বার্তা দিতে শরিক ইতিহাস-গবেষক দেবর্ষি চক্রবর্তী, কলেজ শিক্ষক সামিরুল ইসলামদের মতে, ‘‘বাড়িওয়ালাদের পছন্দ-অপছন্দ নিশ্চয় থাকবে। কিন্তু জাতধর্ম নিয়ে সংস্কার দূর করার কাজটাও আমরা করব।’’ বিপদের সময়ে বন্ধুর খোঁজে এ শহরে সহৃদয় বাড়িওয়ালা বা উদারমনস্ক নাগরিকদের তালিকাও তৈরি করছেন তাঁরা। আর ভাবছেন, পাড়ায় পাড়ায় বৈষম্যের বিরুদ্ধে মানুষকে সজাগ করতে ছোট ছোট আড্ডা আয়োজনের কথাও।

আজ, সোমবার বিকেলে যাদবপুর ৮বি-র মোড়ে একটি ছোট সম্মেলন। এক টুকরো ছাদের আশায় মানুষের হৃদয়ের দরজায় কড়া নাড়ছেন ওঁরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Social Media Facebook Religion
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE