Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
State News

কোন মূর্খ... ? প্রশ্ন কৈলাসের, ফল বেরোতেই তোলপাড় শুরু রাজ্য বিজেপি-তে

২০১৯ সালে বাংলার ৪২টি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে ২২টি দখলের ‘টার্গেট’ নিয়েছেন অমিত শাহ। খবর বিজেপি সূত্রেরই। বাস্তব চিত্র বলছে, ২২টা আসন পাওয়ার মতো অবস্থার ধারেকাছেই পৌঁছয়নি বিজেপি এ রাজ্যে।

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ মে ২০১৮ ১৮:২৮
Share: Save:

তৃণমূল ৩৪ শতাংশের আশপাশে। আর বিজেপি প্রায় ২৮ শতাংশ। পঞ্চায়েত নির্বাচনের সবচেয়ে কাছাকাছি পৌঁছে যে জনমত সমীক্ষা প্রকাশ্যে এসেছে, তাতে এই রকমই ইঙ্গিত ছিল।

বাস্তবে কী রকম দাঁড়িয়েছে ছবিটা? জেলা পরিষদে স্তরেই সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছে বিজেপি। কিন্তু জনমত সমীক্ষায় যেমন ইঙ্গিত ছিল, তার ধারেকাছে পৌঁছয়নি বিজেপির প্রাপ্ত ভোট। ১৯ শতাংশ ছাড়িয়েই থেমে গিয়েছে গেরুয়া রথ। আর শাসক দল অনেকটা ছাপিয়ে গিয়েছে সমীক্ষাকে। পেয়েছে ৫৬ শতাংশেরও বেশি।

এই ফলাফল দেখে বেজায় বিরক্ত বিজেপির জাতীয় নেতৃত্ব। দাবি রাজ্য বিজেপির-ই একাংশের। ‘‘প্রধানমন্ত্রী বাংলার নির্বাচনে হিংসা নিয়ে মুখ খুলেছেন। কিন্তু দলীয় দফতর থেকে ভাষণ দেওয়া সত্ত্বেও এক বারও রাজ্য বিজেপি-কে অভিনন্দন জানাননি। বার্তাটা বুঝতে পারছেন?’’ প্রশ্ন দলের রাজ্যস্তরের এক নেতার। দিলীপ ঘোষ রাজ্য সভাপতি পদে আসার আগে সব সময় সামনের সারিতে দেখা যেত এই নেতাকে। কিন্তু ‘জমানা বদলের’ পরে কিছুটা পিছনে চলে গিয়েছেন। পঞ্চায়েতে বিজেপির ফলাফল নিয়ে নিজের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে বেশ ‘নির্মোহ’ কাটাছেঁড়া করছেন এই নেতা।

কী রকম কাটাছেঁড়া? বিজেপি নেতা প্রশ্নোত্তরের ঢঙে বলতে শুরু করলেন, ‘‘ক’টা আসন পেয়েছি আমারা জেলা পরিষদে? ২৩টা। মেনে নিলাম, প্রবল মারামারি হয়েছে। মেনে নিলাম, ভীষণ হিংসাত্মক পরিস্থিতিতে ভোট হয়েছে। যদি সে সব না হত, তা হলে কত আসন হত? ধরে নিলাম দ্বিগুণ হত। কটা হয়? ৪৬টা। ধরে নিলাম তারও দ্বিগুণ হত। কটা হয়? ৯২টা। জেলা পরিষদে ৯২টা আসন মানে ক’টা বিধানসভা? ৩০টা খুব জোর। ৩০টা বিধানসভা মানে ক’টা লোকসভা? খুব বেশি হলে ৪-৫টা। তা হলে আশানুরূপ ফল হল কোথায়?’’

অস্বীকার করা সত্যিই কঠিন। ২০১৯ সালে বাংলার ৪২টি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে ২২টি দখলের ‘টার্গেট’ নিয়েছেন অমিত শাহ। খবর বিজেপি সূত্রেরই। বাস্তব চিত্র বলছে, ২২টা আসন পাওয়ার মতো অবস্থার ধারেকাছেই পৌঁছয়নি বিজেপি এ রাজ্যে। ভোটের আগে বা ভোটের দিন হিংসা নিয়ন্ত্রণে রাখা গেলেও ৪-৫টার বেশি লোকসভা আসনে এগিয়ে থাকা বিজেপির পক্ষে সম্ভব হত কি না, তা নিয়ে সংশয় বিস্তর।

রাজ্য বিজেপির পারফর্ম্যান্সে সেই কারণেই খুশি নন দলের সর্বভারতীয় নেতৃত্ব, বলছেন রাজ্য কমিটিরই কয়েক জন। ‘‘সবং বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে বিজেপি দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসার পরে খোদ মোদী টুইট করে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন বাংলার বিজেপি-কে। পঞ্চায়েতের ফল প্রকাশের পরে তেমন কিছু আছে?’’ প্রশ্ন রাজ্যস্তরের এক নেতার।

শমীক ভট্টাচার্য অবশ্য সে জল্পনা নস্যাৎ করার চেষ্টা করলেন। বললেন, ‘‘আমাদের দলটার নাম তো কংগ্রেস নয় যে, রাজ্য নেতৃত্ব নিজেদের মতো করে ভোট লড়ল, সব শেষ হওয়ার পরে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বলল, ভাল হয়েছে বা খারাপ হয়েছে। আমাদের দলে তো রাজ্য নেতৃত্বের সঙ্গে জাতীয় নেতৃত্ব নিরন্তর যোগাযোগের মধ্যে রয়েছেন। পঞ্চায়েতের লড়াইয়ে রাজ্য যতটা সামিল ছিল, জাতীয় নেতৃত্বও তো ততটাই। কে কাকে আলাদা করে অভিনন্দন জানাবে বুঝতে পারছি না।’’

দক্ষিণ বসিরহাটের প্রাক্তন বিধায়ক যা-ই বলুন, রাজ্য বিজেপির এক প্রাক্তন সভাপতি কিন্তু চাঁচাছোলা। ফলাফল নিয়ে নিজের মতামত প্রকাশ্যে জানাচ্ছেন না তিনি। কিন্তু ঘনিষ্ঠ মহলে বলছেন, ‘‘অতি উৎসাহ দেখানোর মতো কিছু তো হয়নি। আরও অনেক ভাল ফল হতে পারত।’’ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছ থেকে আলাদা করে অভিনন্দন আসার মতো কিছু নেই— শমীকের এই মত সেই প্রাক্তন সভাপতিও মানছেন। কিন্তু তার সঙ্গেই যোগ করছেন, ‘‘ভাল হলে তো সবাই বলেন। এ বার তো কেউ কিছু বললেনই না। সবাই বুঝতে পারছেন, ফল আরও অনেক ভাল হতে পারত।’’

আরও পড়ুন
দলে আসতে আবেদন করুন, বয়ান তৈরি তৃণমূলে

পঞ্চায়েতের ভোট যে দিন গোনা হচ্ছে, সে দিন রাজ্য মহিলা মোর্চার সভানেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায় ছিলেন দিল্লিতে। লকেটের দাবি, বাংলার পঞ্চায়েতের ফলাফল নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব উচ্ছ্বসিত। তবে ‘উচ্ছ্বাস’-এর যে বিবরণ তিনি দিলেন, তা খুব উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। লকেট বললেন, ‘‘বিভিন্ন আসনে মহিলা প্রার্থীদের জয়ের খবর আমার কাছে সে দিন পৌঁছচ্ছিল। দিল্লির নেতাদের আমি সে সব জানাচ্ছিলামও। সবাই খুশিই হচ্ছিলেন।’’

শমীক ভট্টাচার্যের ব্যাখ্যাটা আবার অন্য রকম। তিনি বলছেন, ‘‘ফলাফল নিয়ে অমুক খুশি, তমুক অখুশি— বিষয়টা এই রকম নয়। প্রবল সন্ত্রাসের মাঝে যে ফল আমরা করেছি, সেটা বেনজির। কিন্তু আরও ভাল ফল তো আমাদের হওয়া উচিত ছিল। জেলা পরিষদ স্তরে প্রায় ২০ শতাংশ ভোট পেয়েছি। আসন সংখ্যায় তার কোনও প্রতিফলন নেই। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, ভোট গুণতেই দেয়নি। এই নির্বাচন নিয়ে খুশি হব কী ভাবে?’’

সবচেয়ে কড়া বয়ানটা এল সর্বভারতীয় নেতৃত্বের প্রতিনিধির কাছ থেকেই। দিল্লির তরফ থেকে পর্যবেক্ষক হিসেবে বঙ্গ বিজেপির ভার সামলাচ্ছেন যিনি, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অসন্তোষ সংক্রান্ত গুঞ্জন প্রসঙ্গ উঠতেই সেই কৈলাস বিজয়বর্গীয় পাল্টা প্রশ্ন ছুড়লেন, ‘‘কোন মূর্খ বলছে যে, জাতীয় নেতৃত্ব খুশি নন?’’ বিজয়বর্গীয় বললেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী এবং সভাপতি ব্যক্তিগত ভাবে আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এই প্রচণ্ড হিংসার মধ্যে আমরা যে ফল করেছি, দু’জনেই তার প্রশংসা করেছেন।’’

তবে কৈলাস যা-ই বলুন, তাঁকে এড়িয়েও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে অন্য রকম বার্তা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা যে চলছে, তা স্পষ্ট হচ্ছে ৬ নম্বর মুরলীধর সেন লেনের অন্দরমহলে একটু সন্তর্পণে কান পাতলেই। সরকারি ভাবে পঞ্চায়েত নির্বাচন সামলানোর দায়িত্ব বর্তেছিল যাঁর কাঁধে, সেই মুকুল রায় নিজেই ভোট পর্ব এবং ফলাফল নিয়ে সন্তুষ্ট নন বলে খবর।

আরও পড়ুন
নির্দল ভোটের হিসেব কই, প্রশ্নের মুখে কমিশন

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যে নেতা জেলা পরিষদের ফলাফল তুলে ধরে দাবি করছিলেন, এ রাজ্যে ৪-৫টার বেশি লোকসভা আসন জেতার মতো অবস্থায় নেই বিজেপি, তাঁর দাবি, ‘‘নীচের স্তরে যাঁদের ভোটের কাজে লাগানো হয়েছে, তাঁদের বেশির ভাগই রাজনীতিতে আনকোরা। রাজনীতিতে পোড় খাওয়া যাঁরা, তাঁদের অধিকাংশকেই বসিয়ে রাখা হয়েছিল। গোষ্ঠীবাজি ভুলে ওঁদের কাজে লাগানো হলে অনেক ভাল ফল হত। পঞ্চায়েত ভোট সামলানোর দায়িত্বপ্রাপ্ত এক নেতা সে কথা আমাদের সর্বভারতীয় নেতৃত্বকে জানিয়েওছেন।’’

বক্তব্য যাঁর যেমনই হোক, পঞ্চায়েত মিটতেই যে বিজেপির অন্দরে অন্য রকম একটা টানাপড়েন তৈরি হয়ে গিয়েছে, তা বেশ স্পষ্ট। ফলাফল নিয়ে দলের সব অংশ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে রাজি নয়। টানাপড়েনটাকে যে দিল্লির দরবার পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, তা-ও ক্রমশ পরিষ্কার হচ্ছে।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Panchayat Results Politics BJP Panchayat Poll
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE