Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

খেজুর গাছে হাঁড়ি বেঁধে দিন গুণছেন শিউলিরা

জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে পা রেখেও চারিদিকে খোঁজ খোঁজ। শীত গেল কোথায়! হাওয়া অফিসের কাছেও তার খবর নেই। খবর নেই মাঠঘাটের মানুষজনের কাছেও। শিউলিদের মুখ ভার। খেজুর গাছে হাঁড়ি ঝুলিয়েও ভাঁড়ে মা ভবাণী। কারণ, ঠান্ডা পড়ছে না বলে রসও উঠছে না। আর রস না উঠলে নলেন গুড়ই বা আসবে কোথা থেকে।

ভাল রসের জন্য এখনও হাহাকার। দেগঙ্গায় সজল চট্টোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।

ভাল রসের জন্য এখনও হাহাকার। দেগঙ্গায় সজল চট্টোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।

নির্মল বসু ও সীমান্ত মৈত্র
শেষ আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:১২
Share: Save:

রোদ্দুরের গায়ে আধো আধো সোনালি রঙ ধরেছে। ভোরের ঘুম ভাঙা সকাল কুয়াশায় মাখামাখি। সকল নিয়ে বসে আছে প্রকৃতি। কিন্তু ‘‘তোমার দেখা নাই!’’

জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে পা রেখেও চারিদিকে খোঁজ খোঁজ। শীত গেল কোথায়! হাওয়া অফিসের কাছেও তার খবর নেই। খবর নেই মাঠঘাটের মানুষজনের কাছেও। শিউলিদের মুখ ভার। খেজুর গাছে হাঁড়ি ঝুলিয়েও ভাঁড়ে মা ভবাণী। কারণ, ঠান্ডা পড়ছে না বলে রসও উঠছে না। আর রস না উঠলে নলেন গুড়ই বা আসবে কোথা থেকে। মোয়া-খ্যাত জয়নগরের ব্যবসায়ীরাও উচাটন। শীত না পড়লে ভাল গুড়ের অভাবে মার খাবে তাঁদের ব্যবসাও। হাওয়া অফিসের থেকে ‘সুসংবাদ’ চেয়ে হাপিত্যেশে সকলেই।

গুড়ের জন্য বরাবর নামডাক আছে বসিরহাটের। এক সময়ে প্রচুর খেজুর গাছ ছিল। ইটভাটা, মেছোভে়ড়ি বা টালি কারখানার জ্বালানির দাপটে সে সব গাছ কেটে অনেকটাই সাফ হয়ে গেলেও এখনও নয় নয় করে যা আছে, রাজ্যের নানা প্রান্তের মানুষকে তা খুশি করার পক্ষে কম নয়।

বসিরহাটের শিউলিদের অনেকেই জানালেন, অগ্রহায়ণের এই সময়ের মধ্যে তাঁরা একেক জন অন্তত দেড়শো থেকে দু’শো খেজুর গাছ কেটে ফেলতেন। অথচ, এ বছর ১০-১৫টির বেশি গাছ কাটতে পারেননি।

নভেম্বরের মাঝামাঝি অর্থাৎ অগ্রহায়ণ থেকেই খেজুর গাছ কাটা শুরু হয়। একটা খেজুর গাছ তিনবার কাটার পরে তাতে নলি লাগিয়ে রসের জন্য ভাঁড় পাতা হয়। একটা খেজুর গাছ থেকে দিনে দু’বার রস মেলে। ভোরের রসকে ‘জিরেন’ এবং বিকালের রসকে ‘ওলা’ বলে। পৌষ মাসে পুরোদমে রস মেলার পরে মাঘ থেকে রস কমতে শুরু করে। ওই সময়ে রসের ঘনত্ব বাড়ে। তবে গাছকাটার পরে প্রথম দিকের রসে গুড় ভাল হয়। ‘‘ওই সময়ে খেজুর গাছের ধারে দাঁড়ালে সুস্বাদু গন্ধে চারধার ম ম করে’’— বলছেন অনেকেই।

সংগ্রামপুরের শিউলি আকবর মোল্লার দাবি, দেড়-দু’ভাঁড় রস জাল দিলে তবে এক কিলোগ্রামের মতো খাঁটি পাটালি মেলে। তবে এ বারে সে ভাবে শীত না পড়ায় এখনও নলেন গুড়ের পাটালি তৈরি শুরুই হয়নি।

সন্দেশখালিতে ‘অমানুষ’ ছবির শ্যুটিঙে এসে এখানকার নতুন গুড়ের কাঁচাগোল্লার প্রেমে পড়েছিলেন মহানায়ক উত্তমকুমার। সকালের টিফিনে কাঁচাগোল্লা তাঁর পাতে দিতেই হত। টাকিতে শ্যুটিং করতে এসে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, মুনমুন সেন, দেব বা সন্দেশখালিতে নাটক করতে আসা রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, কৌশিক সেন, রজতাভ দত্তরা উদ্যোক্তাদের কাছে কাঁচাগোল্লা খাওয়ানোর আবদার করেন এখনও। বসিরহাটের নলেনগুড়ের পাটালিও বড় সাধ করে নিয়ে যান তাঁরা।

বনগাঁর নতুনগ্রাম এলাকাটি কৃষিপ্রধান। এখানে কয়েক হাজার খেজুর গাছ রয়েছে। এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, জানুয়ারিতেও বহু গাছ ঝাড়া হয়নি। কথা হচ্ছিল প্রবীণ চাষি পরিতোষ বিশ্বাসের সঙ্গে। পরিতোষবাবুর অতীতে বহু খেজুর গাছ ছিল। কিন্তু শিউলি পেতে সমস্যা হওয়ায় শীতের মরসুমে তিনি গাছ ঝাড়াতে পারতেন না। একরকম বাধ্য হয়েই ১৬০টির মতো খেজুর গাছ বিক্রি করে দিয়েছেন। হাত প্রতি খেজুর গাছ বিক্রি হয় ৩৫ টাকায়। গাছ কাটার পরে হাত মেপেই বিক্রি হয়। বাইরে থেকে কাঠ ব্যবসায়ীরা গ্রামে এসে গাছ কিনে নিয়ে যান। মূলত ইট ভাটার জ্বালানির জন্য খেজুর গাছের চাহিদা রয়েছে। দামও অন্য গাছের তুলনায় কম। পরিতোষবাবুর মতো বাগদা ও গাইঘাটার বহু চাষিও তাদের খেজুর গাছ বিক্রি করে দিয়েছেন বা দিচ্ছেন। পরিতোষবাবু এবার ২০টি খেজুর গাছ ভাগে দিয়েছেন। দশটি গাছ ঝাড়িয়েছেন। বেশ কিছু গাছ না ঝাড়া অবস্থায় রয়েছে। তিনি জানালেন, ‘‘শীত না পড়ায় রস তেমন ভাবে হচ্ছে না। শিউলিরও অভাব রয়েছে। ভাবছি বাকি গাছও বিক্রি করে দেবো। জাঁকিয়ে শীত না পড়লে বাকি গাছ ঝাড়ার ঝুঁকি নিতে পারছি না ’’

বনগাঁ মহকুমায় খেজুর গাছের মালিকেরা জানালেন, গত বছর এই সময়ে প্রতি সপ্তাহে একটি খেজুর গাছ থেকে ১০-১২ কেজি রস পাওয়া গিয়েছে। সপ্তাহে একদিন গাছ কাটা হলে তিন দিন রস পাওয়া যায়। কিন্তু এ বার একদিনের বেশি রস হচ্ছে না। পরিমাণেও তা ৪ কেজির বেশি নয়। শীত না পড়ায় রসে স্বাদ আসেনি। শীতের সকালে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে খেজুর রস খাওয়ার মজাই আলাদা। কিন্তু ভাল রসের সন্ধান মিলছে না এ বার।

নতুনগ্রাম এলাকায় বছর দশেক আগেও ছ’জন শিউলি ছিলেন। এখন মাত্র দু’জন। তাঁদের পক্ষে সব গাছ ঝাড়া সম্ভব নয়। কেন শিউলির অভাব? স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, নতুন প্রজন্ম এই কাজে উৎসাহ দেখাচ্ছে না। নতুনগ্রাম এলাকার শিউলি রামকৃষ্ণ বাছার ১৯৬৬ সাল থেকে খেজুর গাছ ঝাড়ার কাজ করছেন। এ বারও ১৮০টির মতো গাছ ঝেড়েছেন। তিনি জানালেন, গত বছরেও শীতে প্রতি সপ্তাহে ১৬-১৮ কেজি গুড় তৈরি করেছি। এ বার শীত না পড়ায় তা হচ্ছে মাত্র ৬ কিলোর মতো। রসের স্বাদও আগের মতো নেই।’’ একে তো ভাল গুড়ের আকাল। তার উপরে জোগান কম হওয়ায় দামও বেশি। গত বছর প্রতি কেজি গুড় বিক্রি হয়েছিল ৬০ টাকা কেজিতে। এ বার তা ১৩০ টাকা।

উদ্ভিদবিদরা জানালেন, বাইরের তাপমাত্রা যত কমে, খেজুরের রসের ‘ফ্লোয়েম’ কোষে মিষ্টতা বাড়ে। তা ছাড়া কোষের রূপান্তরের ফলে রসে সুগন্ধ বাড়ে। কিন্তু এ বার শীত না সে ভাবে না পড়ায় সেই প্রক্রিয়া থমকে রয়েছে।

কৃষ্ণগঞ্জের বাসিন্দা চাষি শৈলেন বিশ্বাসের ৭০টি গাছ রয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘চাহিদা আছে জেনে গুড়ের পরিমাণ বাড়াতে চিনি মেশানো হচ্ছে। আবার সুগন্ধীও মেশানো হচ্ছে শুনছি।’’ তবে তাঁর দাবি, তবে গ্রামের কেউ নয়, তা করছেন শহরের ব্যবসায়ীরা। মিষ্টি ব্যবসায়ী হারুগোপাল খাঁ বলেন, ‘‘কলকাতায় মিষ্টির দোকানে নলেন গুড়ের চাহিদা কম। কারণ, প্রায় সকলেই জেনে গিয়েছেন, শীত না পড়লে নলেন গুড় মিলবে না। তাতে যতই চিনি বা সুগন্ধী মেশানো হোক না কেন, মুখে দিলে ফারাক বোঝা যাবে।’’

বরাত নিয়ে বসে আছে জয়নগর। কিন্তু ভাল গুড়ের অভাবে মাল সাপ্লাই করা যাচ্ছে না। জয়নগরের মোয়া নির্মাণকারী সংস্থার সভাপতি রঞ্জিতকুমার ঘোষ জানান, শীত না পড়লে ভাল গুড় হবে কোথা থেকে। খেজুর গাছে রসই আসছে না। তিনি জানান, অন্যান্য বছর ডিসেম্বর মাসের এ রকম সময়ে মোয়ার ব্যবসা চড়তে থাকে। এ বার চাহিদা বেশ কম। ভাল গুড় না উঠলে ভাল মোয়াও যে হওয়ার নয়, তা বিলক্ষণ বুঝেছেন ক্রেতা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

food jaggery
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE