গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণে রাজ্য সরকার আদৌ আগ্রহী কি না, দু’সপ্তাহের মধ্যে স্পষ্ট জানতে চাইল কলকাতা হাইকোর্ট। এই প্রকল্প সম্পর্কে ঘন ঘন নীতি পরিবর্তন নিয়ে বুধবার রাজ্যকে ‘অস্থির’ ও ‘খামখেয়ালি’ বলে তীব্র ভর্ৎসনাও করেছে আদালত।
পূর্ব মেদিনীপুরের বিচুনিয়ায় ওই প্রস্তাবিত বন্দর প্রকল্প নিয়ে জটিলতা চলছে বহু দিন ধরেই। গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের জন্য ‘আম্মা লাইন্স’ নামে মুম্বইয়ের একটি সংস্থাকে বাম আমলে যে ‘লেটার অব ইনটেন্ট’ দেওয়া হয়েছিল, একে তো ক্ষমতায় এসে তা নাকচ করে দেয় তৃণমূল সরকার। অযৌক্তিক ভাবে ওই লেটার অব ইনটেন্ট নাকচ করা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলে ইতিমধ্যেই কোর্টে গিয়েছে সংস্থাটি। উপরন্তু কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষের একটি ‘সাবমেরিন গ্যাসলাইন’ (লিকুইড ন্যাচারাল গ্যাস টার্মিনাল) প্রকল্প সম্প্রতি ঘোষণা হয়েছে। আম্মা লাইন্সের অভিযোগ, ওই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে অত্যন্ত বিপজ্জনক ভাবে প্রস্তাবিত বন্দর এলাকার মধ্য দিয়েই গ্যাসের পাইপলাইন নিয়ে যাওয়া হবে। ফলে বন্দর নির্মাণ একেবারে অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
প্রসঙ্গত, রাজ্য সরকারের সাম্প্রতিক ‘বেঙ্গল লিডস’ শিল্প সম্মেলনে ৪০০০ কোটি টাকার এই পাইপলাইন প্রকল্প ছিল অন্যতম ‘শো-পিস’। প্রকল্পটি স্থানান্তরের আর্জি নিয়ে সম্প্রতি ফের আদালতের দ্বারস্থ হয় আম্মা লাইন্স। তাদের রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি ইন্দ্রপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় বুধবার রাজ্য সরকারের কাছে তিনটি প্রশ্নের উত্তর চেয়েছেন।
১) বিচুনিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দর তৈরির ব্যাপারে রাজ্য সরকার এখনও দায়বদ্ধ কি না।
২) অন্য কোথাও বন্দর তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে কি না।
৩) এই অঞ্চলে বন্দর তৈরি করার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হয়েছে কি না।
এই তিন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজ্যের শিল্পসচিবকে তা আগামী দু’সপ্তাহের মধ্যে আম্মা লাইন্স ও কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিতে হবে বলে নির্দেশ দিয়েছে আদালত। সরকারের পাশাপাশি বন্দর কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়েও অসন্তোষ প্রকাশ করে বিচারপতি তাদের গ্যাসলাইন প্রকল্পের শর্ত স্পষ্ট করে জানানোর নির্দেশ দিয়েছেন। দু’সপ্তাহের মধ্যে আম্মা লাইন্সকেও জানাতে হবে, গ্যাস প্রকল্পে কোনও পরিবর্তন হচ্ছে কি না।
বস্তুত, লেটার অব ইনটেন্ট খারিজ নিয়ে আম্মা লাইন্সের সঙ্গে পুরনো মামলায় আগেই এক প্রস্ত ধাক্কা খেয়েছিল রাজ্য। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের বিচারপতি সৌমিত্র পাল নির্দেশ দিয়েছিলেন, প্রকল্পের জন্য নতুন দরপত্র চাইলেও আদালতের অনুমতি ছাড়া ‘ওয়ার্ক অর্ডার’ দিতে পারবে না রাজ্য সরকার। এর পর মার্চে অন্তর্বর্তীকালীন রায়ে বিচারপতি ইন্দ্রপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়ও সেই নির্দেশ বহাল রেখেছিলেন।
ঘটনাচক্রে, মাস কয়েক আগে একটি বণিকসভার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে কলকাতায় এসেছিলেন জাহাজমন্ত্রী নিতিন গডকড়ী। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও বৈঠক করেন তিনি। সূত্রের খবর, সাগরে গভীর সমুদ্র বন্দর গড়ার জন্য মন্ত্রীর কাছে সহায়তা চেয়েছিল রাজ্য। উত্তরে গডকড়ী বলেছিলেন, রাজনীতি ও উন্নয়নের মধ্যে বিরোধ নেই। ১২০০০ কোটি টাকা দেওয়ার কথাও ঘোষণা করেছিলেন তিনি।
তা সত্ত্বেও স্রেফ আইনি জটিলতায় আটকে গভীর সমুদ্র বন্দর ও গ্যাস টার্মিনাল প্রকল্প মিলিয়ে দশ হাজার কোটিরও বেশি টাকার বিনিয়োগ এখন অনিশ্চিত। এর জন্য রাজ্যের দিশাহীনতাকেই দায়ী করছেন অনেকে। বিশেষত বন্দর তৈরির জন্য লগ্নিকারী পেয়েও রাজ্য কেন তা হেলায় হারাচ্ছে, তার কোনও যুক্তি খুঁজে পায়নি শিল্পমহল। কলকাতা ও হলদিয়া— দুই বন্দরেই নাব্যতার অভাবে জাহাজ আনাগোনা বন্ধ হতে বসেছে। যার সমাধান সূত্র হিসেবেই গভীর সমুদ্র বন্দরের প্রসঙ্গ উঠে এসেছিল। অথচ গোড়া থেকেই এই প্রকল্প ঘিরে প্রশাসনের তরফে উদাসীনতা ও অসহযোগিতার অভিযোগ উঠেছে। রাজ্যের বিনিয়োগ-চিত্র এমনিতেই বেহাল। এই পরিস্থিতিতে বন্দর-নিয়ে আইনি জট বিনিয়োগকারীদের
কাছে রাজ্য সম্পর্কে ফের নেতিবাচক বার্তাই পৌঁছে দিল বলে আক্ষেপ করছেন অনেকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy