শুভলগ্না চক্রবর্তী এবং সুলতান। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
একটা মাত্র সিসার বুলেট— পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে সেকেন্ডেরও ভগ্নাংশে শুভলগ্নার বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে যায়। শেষ হয়ে যায় লম্বা টানাপড়েন। সঙ্গে ‘বাইশ’ বছরের সম্পর্ক।
বৃহস্পতিবার ভর সন্ধ্যায় কোন্নগরে শুভলগ্না চক্রবর্তীর বাড়িতে ঢুকে তাঁকে গুলি করে খুন করেন প্রেমিক সুলতান আলি। কিন্তু, এই খুনের কারণ কী? প্রথমে জানা গিয়েছিল, সুলতান আলি নামে এক যুবকের বিয়ের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায়, সেই আক্রোশ থেকেই এই খুন। কিন্তু ঘটনার পরের দিন ঘটনাস্থলে গিয়ে খুঁজে পাওয়া গেল অনেক অজানা কাহিনি যা, এই খুনের কারণকে কেবল জটিলই করে তুলল না, পরতে পরতে বাড়িয়ে দিয়েছে রহস্য।
কোন্নগর পুরসভার অবসরপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার তুষার চক্রবর্তীর বাড়ি অলিম্পিক মাঠের পাশে। সেই বাড়ি থেকে পাশের করাতি পাড়ার শেখ ইসলামের বাড়ির ব্যবধান কার্যত একটা পাঁচিল। স্কুল-কলেজে যাতায়াতের রাস্তা থেকে খেলার মাঠ সবই এক। আর তাই তুষার-শুভ্রার বড় মেয়ে শুভলগ্নার সঙ্গে শেখ ইসলামের ছোট ছেলে সুলতানের ঘনিষ্ঠতা কখন যে তৈরি হয়েছে তা টেরই পাননি অভিভাবকেরা। তাই ইসলামকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়, সুলতানের সঙ্গে শুভলগ্নার সম্পর্ক কত দিনের, তিনি বলেন, “কম করে বাইশ বছর। ছোটবেলা থেকেই তো দু’জনকে দেখছি। একটা সময়ের পর সেটা খুব প্রকাশ্যেই ছিল, পাড়ার সবাই জানত।”
আরও পড়ুন: বিয়েতে ‘না’, তরুণীকে বাড়ির সামনে গুলি করে খুন কোন্নগরে
শুভলগ্নার পরিবার সেই দাবিকে মেনে না নিলেও, সতেরো বছর আগে অর্থাৎ ২০০১ সালে যে শুভলগ্না এবং সুলতান যে বিয়ের প্রস্তুতি রীতিমতো আইন মেনে করেছিলেন, তার নথি কিন্তু এখনও রয়েছে।
তা হলে এত বছরের সম্পর্কের এই পরিণতি কেন?
শুভলগ্নার বাবা-মায়ের দাবি, “কয়েক বছর আগে দু’জনের ,সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল সেটা ঠিক। ২০১৪ সালের মার্চ মাসে আমাদের লুকিয়ে রেজিস্ট্রি করে বিয়েও করেছিল ওরা। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরেই শুভলগ্না বুঝতে পারে তার ভুল। বৈবাহিক সম্পর্ক থেকে সরে আসতে চাইছিল ও। আর সেই কারণেই সুলতানের আক্রোশ জন্মাচ্ছিল শুভলগ্নার উপর।”
দেখুন ভিডিও:
২০১৭ সালের শেষ দিকে সুলতানের বিরুদ্ধে বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা শুরু করেন শুভলগ্না। সুলতান কোনও ভাবে বিবাহ বিচ্ছেদে রাজি ছিলেন না। শুভলগ্নার কাকা কৌশিকের অভিযোগ, “বিচ্ছেদের মামলা শুরু হওয়ার পর থেকেই আমার ভাইঝিকে প্রচণ্ড বিরক্ত করা শুরু করে সুলতান। বাড়িতে এসে হুমকি দেওয়া শুরু করে। গত বছর পূজোর সময় এক দিন বাড়ি এসে রীতিমতো হামলা চালায়। বাধ্য হয়ে পুলিশের সাহায্য চাই আমরা। এর পর বিধায়ক থেকে শুরু করে পুরপ্রধানের কাছেও গিয়েছি বার বার। তাতেও সুলতানের উৎপাত কমেনি বরং বেড়েছে।”
সুলতানের বাবা স্বীকার করে নেন যে, যখন থেকে শুভলগ্না বিচ্ছেদের মামলা করেন সেই সময় থেকে তাঁর ছেলে প্রায় পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল। ইসলাম বলেন, “সুলতান জানতে পেরেছিল, শুভলগ্নার পরিবার শ্যামবাজারের এক ব্যাঙ্ক কর্মচারীর সঙ্গে তার বিয়ে পাকা করার চেষ্টা করছে। শুভলগ্নাকে ও নিজের স্ত্রী বলেই মনে করত। নিজের স্ত্রীর অন্য কোথাও বিয়ে হবে এটা মানতে পারেনি আমার ছেলে। তাই যার সঙ্গে শুভলগ্নার বিয়ে ঠিক হচ্ছিল, সেই ছেলের বাড়িতে গিয়েও সব নথিপত্র দেখিয়ে বিয়ে ভাঙতে অনুরোধ করেছিল সুলতান।”
তাঁদের বিয়ের সার্টিফিকেট
শুভলগ্না যে তাঁর স্ত্রী সেটা প্রকাশ্যে জানাতে ফেসবুকে শুভলগ্নার ছবি দিয়ে তাঁকে স্ত্রী বলে দাবি করে সুলতান। আর সেই কারণে তাঁকে গ্রেফতারও হতে হয়েছিল। সুলতানের বন্ধু গফ্ফর বলেন, “২০১৭ সাল থেকে দু’বার শুভলগ্নার পরিবারের অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছে সুলতান। তার পরেও আশা ছাড়েনি। ধারণা ছিল, শুভলগ্না ওর কাছে ফিরে আসবে।” আদালতে শুভলগ্নার দায়ের করা বিবাহ বিচ্ছেদের মামলায় অন্যতম হাতিয়ার যে শুভলগ্না কখনও সুলতানের সঙ্গে একসঙ্গে থাকেননি। ইসলাম তার উত্তরে বলেন, “বিয়ের পর আমাকে জানিয়েছিল সুলতান যে সে আলাদা থাকবে শুভলগ্নাকে নিয়ে। এই পাড়াতেই বাড়ি ভাড়া নিয়েছিল। আসবাবপত্র কিনেছিল।”
আরও পড়ুন: প্রশিক্ষকের ধাক্কা, ক্যামেরার সামনেই ছাত্রীর মৃত্যু
আর সেখানেই প্রশ্ন, যে ছেলে এত কিছুর পরও শুভলগ্নাকে ফিরে পাওয়ার আশা ছাড়েনি, সে হঠাৎ তাঁর সেই ‘স্ত্রী’-কেই কেন খুন করবে?
শুভলগ্নার এক আত্মীয় বলেন, “নভেম্বরেই শুভলগ্নার বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গিয়েছিল।” তা হলে কি সেটাই সুলতানকে এই হঠকারী সিদ্ধান্তের দিকে এগিয়ে দেয়? সুলতানের পরিবারের অভিযোগ, “পেশায় ইমারতি মালপত্রের ব্যবসায়ী সুলতান, শুভলগ্নার দৈনন্দিন খরচের একটা বড় অংশই বহন করত। শুভলগ্নার ভাই শুভায়ু যে কুয়েতে চাকরি করে তাকে খুব ভালবাসত সুলতান। তাকে কুয়েতে পাঠাতে ব্যাঙ্ক থেকে দু’লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিল সে।” চক্রবর্তী পরিবার যদিও এই দাবি অস্বীকার করেছে।
কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরে ঘটে চলা অনেক ঘটনা যে গোটা পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল করে তুলেছিল তা স্বীকার করে নিয়েছেন এলাকার এক নেতাও। তাঁর কাছে চক্রবর্তী পরিবার সুলতানের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে গিয়েছিল। তিনিও মেনে নেন, এলাকার মানুষও এঁদের সম্পর্ক বিষয়ে জানত।
বৃহস্পতিবার রাতেই থানায় গিয়ে অস্ত্র-সহ আত্মসমর্পণ করে সুলতান। থানায় আগাগোড়া স্বাভাবিক আচরণ ছিল তাঁর। আর সেই অতিরিক্ত স্বাভাবিকত্বই সুলতানের মানসিক ‘সুস্থতা’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে তদন্তকারীদের কাছেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy