নির্বাচনে চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়লেও সমর্থনের নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে বামপন্থীদের— যা তাদের ফের ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করবে বলে মনে করে চিনের প্রভাবশালী পত্রিকা ‘সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট’। পত্রিকাটির আন্তর্জাতিক এডিশনে ‘দিস উইক ইন এশিয়া’ বিভাগে একটি রাজনৈতিক নিবন্ধ প্রকাশ করা হয়েছে, যার শিরোনাম— ‘ভারতের কমিউনিজম: মৃত না তরুণদের হাত ধরে ঘুরে দাঁড়ানোর অপেক্ষায়?’ এই প্রতিবেদনে ভারতের দুই কমিউনিস্ট পার্টির অতীত ও বর্তমান নিয়ে কাটাছেঁড়া করে বলা হয়েছে, গত পাঁচ বছরে সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে বাঁক নিয়েছে ভারতের বামপন্থা, যার ফলে বিজেপির মতো চরম দক্ষিণপন্থী শক্তির মোকাবিলায় নতুন শক্তি হিসেবে উঠে আসার সম্ভাবনা রয়েছে তাদের।
চিনের ‘সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট’ সরকার বা কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র নয়। বরং বিতর্কিত বহুজাতিক চিনা শিল্পগোষ্ঠী আলিবাবা এর মালিক। অতীত পর্যালোচনা করতে গিয়ে সিপিএম এবং সিপিআইকে রেয়াত করা হয়নি তাদের পত্রিকার প্রতিবেদনে। উল্লেখ করা হয়েছে, ২০০৪-এর নির্বাচনে দুই কমিউনিস্ট পার্টি পশ্চিমবঙ্গে ৩২টি আসনে লড়ে ২৬টিতে জয়ী হয়। ১০ বছর পরে তা কমে দাঁড়ায় দুইয়ে, আর এ বারের নির্বাচনে অধিকাংশ সমীক্ষাই বলছে— হয় তারা কোনও আসন পাবে না, অথবা কোনও ক্রমে একটা পেলেও পেতে পারে।
কেন এই ধস, তা খুঁজতে ভারতের রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েছেন নিবন্ধকার। তাঁরা বলেছেন, বামপন্থার নীতি আদর্শ থেকে বিচ্যূতিই কাল হয়েছে বাংলার সিপিএমের। ভূমি সংস্কারের সাফল্যে কৃষকদের মধ্যে যে সমর্থনের ভিত তৈরি হয়েছিল, মূলত সেই জোরেই রাজ্যে তারা একটানা রাজপাট চালিয়েছে। কিন্তু সামাজিক চাষের মতো পদক্ষেপে ভূমি সংস্কারকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বদলে বেসরকারি শিল্পমালিকদের জন্য কৃষিজমি অধিগ্রহণে নামে সিপিএম।
যার ফলে কৃষকদের মতো চিরাচরিত সমর্থকেরা তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। দলিত ও পিছিয়ে পড়া শ্রেণির সঙ্কট ও সমস্যার বিষয়গুলিও সিপিএম-সিপিআই ও বামপন্থী দলগুলি কোনও দিন গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি বলে অভিযোগ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষের ক্ষোভকে গুরুত্ব না-দেওয়ার বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছে, যার ফলে পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছর ও ত্রিপুরায় ২৫ বছরের বাম শাসনের অবসান হয়েছে।
কিন্তু গত পাঁচ বছরে নতুন কী বাঁক নিয়েছে ভারতের বামপন্থা?
নিবন্ধে বলা হয়েছে— এক দল তরুণ সমর্থক চরম দক্ষিণপন্থার বিকল্প হিসেবে বামপন্থাকে বেছে নিচ্ছেন। কানহাইয়া কুমার, জিগ্নেশ মেবাণী, শেহলা রশিদেরা তাঁদের নেতা হিসেবে যেমন জনপ্রিয়তা পাচ্ছেন, তেমনি দলিতদের সমস্যার বিষয়টিও ভারতীয় বামপন্থায় গুরুত্ব পাচ্ছে। নতুন এই জনপ্রিয় নেতৃত্বকে সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি ব্যাখ্যা করেছেন ‘নীল আকাশে লাল তারা’ হিসেবে। আবার ছাত্র ও কৃষক আন্দোলনকে হাতিয়ার করে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও কেরলের বাইরে এই প্রথম রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, হিমাচলপ্রদেশ, হরিয়ানা ও কর্নাটকে বামপন্থী শক্তি সংহত হচ্ছে। সিপিএমের গণসংগঠন সারা ভারত কিসান সভার নেতা বিজু কৃষ্ণন জানিয়েছেন, নরেন্দ্র মোদীয় শাসনে কৃষক আন্দোলন করতে গিয়ে তাঁরা যেমন অনেক নতুন বিষয় শিখেছেন, তেমনই বড় জোতজমির মালিকদের মতো একেবারে নতুন শ্রেণির সমর্থন পেয়েছেন। বিজু জানিয়েছেন, ‘‘মোদীর কৃষক-বিরোধী নীতি ক্ষুদ্র ও ধনী কৃষকদের এক মঞ্চে এনে দিয়েছে।’’
সিপিআই (এমএল) লিবারেশনের ছাত্র সংগঠনের প্রাক্তন নেত্রী শেহলা রশিদ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, জিগ্নেশ মেবাণীর মতো তরুণ দলিত নেতার হাত ধরেই নতুন বাম শক্তি উঠে দাঁড়াতে পারে। নির্দল প্রার্থী হিসেবে গুজরাতের মতো রাজ্যে নির্বাচনে জিতে বিধানসভায় গিয়েছেন মেবাণী। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৃদ্ধতন্ত্রকে সরিয়ে জনপ্রিয় তরুণ নেতাদের দলের সামনের সারিতে আনাটাও গুরুত্বপূর্ণ। নিবন্ধে বলা হচ্ছে, ভারতের বামপন্থা এখন আর ক্যাডারতন্ত্রে আটকে রাখা যাবে না। দক্ষিণপন্থার মোকাবিলায় যে নতুন বামপন্থী শক্তি উঠে আসছে, তার মূল নীতি হতে চলেছে— শতফুল বিকশিত হোক। আর সে জন্য কর্মীদের মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারও দিতে হচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy