ছবি: সংগৃহীত।
মাথায় খাটো, আনাড়ি এলেবেলে ছোকরাটিকে ‘নকুলদানা’ বলে ডাকার দিন কি তবে শেষ হতে চলেছে?
খবরের কাগজে শিরোনাম হওয়ার গরিমায় এটুকু আশা সে করতেই পারে! নেহাতই ক্ষুদ্র, আপাত তুচ্ছ দানাটি! ভোট-প্রচারের উপকরণ হিসেবে তবু তাকে দেখেই বিচলিত বিরোধী-শিবির। বীরভূমে শাসক দলের ভোটযুদ্ধের কাপ্তেন অনুব্রত মণ্ডলের নতুন উদ্ধৃতির সূত্র ধরে নকুলদানাকেই যেন নতুন ভাবে আবিষ্কার করছে আমবাঙালি।
ফলে চওড়া হাসি, বোলপুরের কাছারিপট্টির বাতাসা-নকুলদানা কারবারি থেকে শ্যামবাজার মোড়ের সাবেক খই-মুড়কি-বাতাসা-নকুলদানা বিক্রেতার চোখেমুখে! কাশীপুরে সর্বমঙ্গলাঘাটের অদূরে নকুলদানা কারখানার অ-বাংলাভাষী কর্তা রাকেশ গুপ্ত পর্যন্ত অনুব্রতর নকুলদানা-প্রীতি অবগত! তিনিও হাসছেন, ‘‘পুজোটুজোয় বাড়তি নকুলদানার জোগান তো রাখতেই হয়, ভোটপুজোয় কাজে লাগলেও না-হয় তৈরি থাকব।’’
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
অনুব্রত মণ্ডলের সাঙ্কেতিক ভাষা নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন, নকুলদানার মধ্যে তাঁরা অবশ্য নানা মানে খুঁজছেন। গত লোকসভা ভোটে যেমন অনুব্রত বা কেষ্টদা-র ‘গুড়জল’-তত্ত্ব নিয়ে কাটাছেঁড়া হয়েছিল। জল ঠান্ডা করে, গুড় গরম। ভিড়ে-ঠাসা ঘরে প্রকাশ্যে তাঁর সেনাপতিদের ফোন করে সময় বুঝে ঠান্ডা-গরমে কিংবা গুড়-জলে ভোটপর্ব সুসম্পন্ন করার লাগাতার নির্দেশ দিয়েছিলেন কেষ্ট। এর পরেও অনুব্রতর জবানির সূত্র ধরেই ভোটপুজোয় কখনও ‘গুড়-বাতাসা’ প্রয়োগ হয়েছে কিংবা ‘চড়াম-চড়াম’ ঢাক বেজেছে। কেষ্টদার নকুলদানা কি চুষে খাওয়ার না অন্য ভাবে প্রয়োগের? ধন্দ থাকলেও বোলপুরের তৃণমূল প্রার্থী তাঁর প্রচারে ঢালাও নকুলদানা বিলি করে ফেলেছেন।
ভোটের নকুলদানায় প্রতীকি ব্যঞ্জনা যা-ই থাক, কলকাতার বড়বাড়ির কর্তা রাজেন্দ্র মল্লিকের উত্তরপুরুষ হীরেন মল্লিকের মতে, ‘‘এ হল পরম বৈষ্ণব মিষ্টি। বৈষ্ণব পদাবলী, চৈতন্য চরিতামৃত থেকে রাধিকার শতনাম গীতাঞ্জলির নানা আচারে কাঁসার বাটিতে নকুলদানা নিবেদনের খুঁটিনাটি রয়েছে।’’ ওড়িশার শ্রীপটের রাধাকৃষ্ণ থেকে মল্লিকদের গৃহদেবতার নিত্যসেবায় অতিআবশ্যিক তার উপস্থিতি। জগন্নাথের নিদ্রাভঙ্গে বাল্যভোগে মাখন-মিছরিযোগে নকুলদানা, একটু বাদেই জলপানি ভোগে রুপোর পাত্রে পান-সুপুরি-ছোলা-আদা-মিছরির সঙ্গী নকুলদানা কিংবা বৈকালিক ভোগেও হরির লুঠের বাতাসার সহচর সেই নকুলদানাই।
নির্বাচন কমিশনের শো-কজ়ের জবাবে অনুব্রতও নকুলদানার প্রসাদী মহিমাই মেলে ধরছেন। গুড়জলের দাম বেড়ে গিয়েছে, তাই এ বার ভোটে নকুলদানার দাওয়াইয়ের কথা বলেছিলেন তিনি। কমিশন কারণ দর্শাতে বলায় রাঢ়বঙ্গের তৃণমূল নেতার ব্যাখ্যা, এই খুদে দানা আদতে সর্বভারতীয়। বৈষ্ণোদেবী, তিরুপতি, অজমেঢ় শরিফ থেকে সিউড়ির কাছে পাথরচাপুড়ির পির ‘দাতাবাবা’র থান পর্যন্ত যে দানা সর্বত্রগামী। বোলপুরের কাছারিপট্টির নকুলদানা নির্মাতা গৌরাঙ্গ বিশ্বাসের স্ত্রী গৌরীর কণ্ঠে খুশি ঝরে, এমনিতে রোজ ১০-১৫ কেজি বিকোলে, এখন ৩০-৩৫ কেজি দানা তৈরির ঝক্কি পোহাতে হচ্ছে।
ইতিহাসবিদ গৌতম ভদ্র অবশ্য মনে করেন, ‘‘নকুলদানা আগেও থাকলেও এই ধবধবে চিনির লজেন্সের গুলি, ইংরেজরা চিনির কল বসানোর পরেই হয়েছে। গত শতকেও গান গেয়ে ঘুঙুর পরে নকুলদানা বিক্রি করতেন শহুরে ফেরিওয়ালারা।’’ বাস্তবিক, চিনির মণ্ড হিসেবে নকুলদানাকে চিনলেও ছোলা-বাদামযোগে দানা পাকিয়ে নকুলদানাও এক সময়ে সহজলভ্য ছিল। গৌতমবাবুর কথায়, ‘‘নকুল মানে ছোট! আবার মুখরোচক খাদ্যবস্তুও। ভারতচন্দ্রেও কিন্তু নকুলদানার উল্লেখ রয়েছে।’’
ভোটের আবহে নকুলদানা শব্দটির প্রসারণে মজা পাচ্ছেন অবসরপ্রাপ্ত আইএএস-কর্তা তথা রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক জহর সরকারও। একদা অজিত পাঁজার নিজের ছবি-ছাপা দেশলাই বিলির মতো নকুলদানা বিলিতে বিধিভঙ্গ না-দেখলেও তাঁর টিপ্পনী: ‘‘জানি না, নকুলদানায় কী মিছরির ছুরি মিশে! সব বুঝতে একটা নতুন রাজনৈতিক অভিধান লাগবে!’’
গত শতকে কবীর সুমনের গানও অনেকের স্মৃতিতে সজীব! ‘ভরসা থাকুক মুড়কি মুড়ি নকুল দানা আর বাতাসায়, ভরসা থাকুক আরও বিরল চাকরি পাওয়ার জ্যান্ত আশায়!’ হঠাৎ রমরমা পসারে নকুলদানা-কারবারি গৌরাঙ্গের আশা: ‘‘এমন চললে, লাখ দুই খরচ করে মেশিন কিনেই নকুলদানা গড়ব। ফুটন্ত চিনির ডেলা ঘাঁটতে গিয়ে তখন আর হাতে ফোস্কা পড়বে না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy