Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

নয়াচরে বসে ও-পারের আলোর শহর দেখেন শুভেন্দুরা

তবে কি এখানে শিল্প হলে সুবিধা হত? এর স্পষ্ট উত্তর দিতে পারেননি ওঁরা। বলেছেন, ‘‘আমাদের না তাড়িয়ে শিল্প হলে হোক। ছেলেমেয়েরা কাজ পাবে।’’

সোমনাথ পানি। নিজস্ব চিত্র

সোমনাথ পানি। নিজস্ব চিত্র

গার্গী গুহঠাকুরতা
শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০১৯ ০৩:০৭
Share: Save:

সারি সারি চৌখুপি মাছের ভেড়ি। মাঝে মাঝে একফালি আলপথ। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে শুকোচ্ছে মাছ ধরার জাল। এর মাঝেই বেড়া-দরমার ঘরগুলি। একটা ঘরের সঙ্গে অন্য ঘরের দূরত্ব অনেকটাই। জনমানুষ কম। চারপাশ শান্ত, প্রায় নিস্তব্ধ। আওয়াজ বলতে একটানা রোটার বা স্পাইরালের শব্দ। চিংড়ির ভেড়িতে যে যন্ত্রের সাহায্যে জলে অক্সিজেন পাঠানো হয়।

হুগলি ও হলদি নদীর মোহনায় ৬৪ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এই দ্বীপভূমির নাম নয়াচর। হলদিয়া টাউনশিপ নদীঘাট থেকে ভটভটি চড়ে মিনিট চল্লিশের পথ। তবে সকালে একবারই পাওয়া যায় ওই ফেরি। যাত্রী প্রায় নেই। তাই ফেরিও নেই। যে ভটভটি ভাড়া করে ওই দ্বীপে পৌঁছনো গেল, তার চালক নন্দীগ্রামের বাসিন্দা সোমনাথ পানি জানালেন, নয়াচরে তাঁর গ্রামের অনেকেরই মাছের ভেড়ি রয়েছে। তাঁরা অস্থায়ী ভাবে ওখানে বাস করেন।

নৌকো ডাঙায় ভিড়ছে দেখে জাল মেরামতির কাজ ছেড়ে উঠে এলেন এক জন। হাঁক পেড়ে কুশল জানতে চাইলেন সোমনাথের। একই গ্রামের বাসিন্দা সুবল জানা। প্রায় দু’দশক ধরে এখানে মাছ ধরার কাজ করেন। কিন্তু পরিবার নিয়ে এখানে পাকাপাকি ভাবে বাস করার কথা ভাবেননি। কেন? প্রশ্ন শুনে খুব ভাল করে জরিপ করলেন। পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘‘চারপাশ দেখে আপনার মনে হচ্ছে এখানে বউ-বাচ্চা নিয়ে থাকা যায়? সাধারণ গ্রামে যে সুযোগ-সুবিধা থাকে, তার ছিটেফোঁটা এখানে নেই। ছেলেরা পড়াশোনা শিখুক। না হলে পেটের টানে ওদেরও বাড়িঘর ছেড়ে এ ভাবে পড়ে থাকতে হবে।’’ ভিন্ন মত নয়াচরের আর এক বাসিন্দা শক্তিপদ জানার। মাছ ধরার কাজ আছে বলেই দু’ বেলা দু’ মুঠো খেতে পারছে পরিবার। তিনি বলেন, ‘‘দুই ছেলেও আমার সঙ্গে রয়েছে। গরিবের ঘরে লেখাপড়া শেখানো যায়নি। কিন্তু মাছ ধরা দেখে দেখেই শিখেছে তারা।’’

তবে সুবল ও শক্তিপদ জানালেন তাঁদের মতো স্থানীয়দের তুলনায় এখানে সংখ্যায় বেশি ভিন্‌ জেলার মানুষ। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া থেকে কাজ করতে এসেছেন। বাঁকুড়ার সঞ্জয় মুর্মু, পুরুলিয়ার বাবু সরেনরা এক চিলতে ঘরে ঠাসাঠাসি করে থাকেন শুভেন্দু জানা, বাবুলাল পানির সঙ্গে। সকলেরই বয়স ১৬ থেকে ১৮। সন্ধ্যা নামলে মোবাইলে গান শুনতে শুনতে ও পারে শহরের আলো ঝলমলে রূপ দেখে সবাই।

তবে কি এখানে শিল্প হলে সুবিধা হত? এর স্পষ্ট উত্তর দিতে পারেননি ওঁরা। বলেছেন, ‘‘আমাদের না তাড়িয়ে শিল্প হলে হোক। ছেলেমেয়েরা কাজ পাবে।’’ দ্বীপের বাসিন্দাদের থেকে ভটভটি চালক সোমনাথের উত্তর আলাদা। বছর একুশের তরুণ মাধ্যমিক পাশ করার পর থেকেই ভটভটি চালাচ্ছেন। দিনে ১৯০ টাকা রোজগার হয়। তবে তা বছরভর নয়। টানের সময় জল শুকিয়ে চড়া পড়ে যায়। তখন ফেরি চলে না। শিল্পের প্রশ্নে সোমনাথের স্পষ্ট জবাব, ‘‘কিছু হোক। যতটুকু লেখাপড়া শিখেছি, তাতে একটা কাজ পাওয়ার আশা থাকবে।’’

এই দ্বীপ এক সময় খবরের শিরোনামে উঠে এসেছিল। রসায়ন তালুক তৈরির জন্য চিহ্নিত হয়েছিল নয়াচর। বাম আমলে প্রস্তাব ছিল পাঁচ থেকে ছয় হাজার কোটি টাকা ঢেলে তৈরি হবে তালুকের পরিকাঠামো। সেই পরিকাঠামোর টানে আসার কথা ছিল পেট্রোপণ্য উৎপাদক ও সংশ্লিষ্ট অনুসারী শিল্পের। পরিকল্পনা স্তরেই আটকে যায় প্রকল্প। পরিবেশ মন্ত্রকের ছাড়পত্র মেলেনি।

এর মাঝেই রাজ্যে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটে। ঠিক হয় নয়াচরে রসায়ন তালুক তৈরি হবে না। পরিবেশ বাঁচিয়ে তৈরি হবে পর্যটন, হালকা শিল্প ও বিদ্যুৎ প্রকল্প। রাজ্য সরকার ও বিনিয়োগকারী, দু’পক্ষই রাজি হয়। সেই প্রস্তাব অনুযায়ী ৬০০০ একর জমিতে পর্যটন শিল্প তৈরির কথা ছিল। ৪০০০ একরে শিল্প তালুক গড়ে তোলার পরিকল্পনার পাশাপাশি বিদ্যুৎ, নিকাশি, জল, ইত্যাদি পরিষেবার পরিকাঠামোর জন্য ১০২৮ একর জমি চিহ্নিত করা হয়েছে। ২৫০ থেকে
৪০০ একর জমিতে নয়াচরের বাসিন্দাদের জন্য পুনর্বাসন প্রকল্প তৈরি প্রস্তাব ছিল।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

কিন্তু এই প্রকল্পও আলোর মুখ দেখেনি। এক দিকে অভিযোগ ওঠে, শুধুমাত্র জমি নেওয়ার লক্ষ্যেই বিনিয়োগকারীর ‘উৎসাহ’ রয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়িত করার দিকে তেমন নজর নেই। অন্য দিকে কেন্দ্রীয় সরকারের দফায় দফায় মতবদলও বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য নতুন করে নয়াচর নিয়ে পরিকল্পনা করেন। নয়াচরে পরিবেশ-বান্ধব পর্যটন প্রকল্প তৈরি হবে বলে তিনি জানান। জেলা প্রশাসনের দাবি, নির্বাচনের কারণে প্রকল্পের কাজ এখন বন্ধ রয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Lok Sabha Election 2019 Politics TMC BJP
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE