Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Lok Sabha Election 2019

লক্ষ্যভেদে নজর অর্জুনের, বাণ তৈরি মদনেরও

বক্তার নাম মদন মিত্র। অনেক চড়াই-উতরাইয়ের পরে তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যাঁকে ভাটপাড়ায় লড়তে পাঠিয়েছেন।

—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

সুপ্রকাশ মণ্ডল
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০১৯ ০৩:৩৪
Share: Save:

সরু গলি রাস্তাটা যেখানে বড় রাস্তায় এসে মিশেছে, তারই এক কোণে বটগাছটি একলা দাঁড়িয়ে। জগদ্দলের দিক থেকে এসে ঘোষপাড়া রোড সিধে কাঁকিনাড়া চলে গিয়েছে। তপ্ত দুপুরে পুড়ছে পথঘাট। সাইকেল থামিয়ে বুড়ো বটের ছায়ায় দাঁড়িয়ে মুখ মুছলেন যে প্রবীণ, তাঁর নাম শিউচরণ রাম।

এক ভোটের নখের কালি শুকোয়নি এখনও। ফের ভোটের কথা পাড়তেই বড় করুণ দেখাল বৃদ্ধ শিউচরণের মুখ। তবুও প্রশ্নটা করেই ফেললাম। কী চান এ বারের ভোটে?

“শান্তি চাহিয়ে বাবু। সির্ফ শান্তি। ইস বার মাহল কুছ ঠিক নেহি লগ রহা হ্যায়। চুনাও অ্যায়সা হো কি উসকে বাদ লোগ চ্যান সে শো সকে।” এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে দু’হাঁটুর মধ্যে ঘাঁড় গুঁজে দিলেন বৃদ্ধ। শিউচরণের কথাগুলোই যেন এ বার ভাটপাড়া বিধানসভা কেন্দ্রের উপ-নির্বাচনের রিংটোন। অলিতেগলিতে কান পাতলেই ভোট-মাইকের আওয়াজ ছাপিয়ে যে শব্দ দিব্যি কানে আসছে।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

কী আশ্চর্য, শুধু আমজনতা নয়, রোদজ্বলা দুপুরে দু’টি ওয়ার্ড পায়ে হেঁটে প্রচার করে অস্থায়ী আস্তানায় ফিরে ছোট্ট সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে চুপচাপ মিনিট পাঁচেক টানা দম নিলেন যিনি, তিনিও বলছেন— “ভাই, শান্তির ভোট হোক ভাটপাড়ায়। মানুষ তাই চাইছে। এ বারের ভোটটা মানুষের উপর ছেড়ে দেওয়া হোক।” বক্তার নাম মদন মিত্র। অনেক চড়াই-উতরাইয়ের পরে তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যাঁকে ভাটপাড়ায় লড়তে পাঠিয়েছেন। উল্টো দিকে প্রার্থী এক জন আছেন বটে। তবে তাঁর আসল লড়াইটা যে অর্জুন সিংহের সঙ্গে, তা বিলক্ষণ জানেন পোড়খাওয়া মদন। আর এত দিন ধরে ভাটপাড়া মানেই ছিল অর্জুন।

এক নজরে - ভাটপাড়া

• মোট ভোটার: ১,৪৮,৩১২
• ২০১৪ লোকসভা ভোটে তৃণমূল এই কেন্দ্রে ২৪৫৯ ভোটে পিছিয়ে ছিল।
• সেই ভোটে ব্যারাকপুরের তৃণমূল প্রার্থী দীনেশ ত্রিবেদী ২,০৬,০১৩ ভোটে এই কেন্দ্রে জয়ী হন।
• ২০১৬ বিধানসভা ভোটে তৃণমূল প্রার্থী অর্জুন সিংহ ২৯,০৬৩ ভোটে জয়ী হন।

সফেদ পাজামা-কুর্তার তরুণও কিন্তু শান্তির কথাই বলছেন। তিনি ভাটপাড়ার সদ্য প্রাক্তন বিধায়ক অর্জুনের পুত্র পবন। বাবার মতোই ছোটখাটো চেহারা। মুখের হাসিটা সর্বক্ষণ ধরে রাখার প্রাণপণ চেষ্টাটা সাদা চোখেই ধরা পড়ছে। ৩০ বর্ষীয় পবন বলছেন, “প্রচারে যেখানেই যাচ্ছি, সবাই শান্তির কথাই বলছে।”

এই যদি হয় সরল পাটিগণিতের হিসেব, তা হলে ভাটপাড়ার ভোট-স্লেটে আছে আরও অজস্র আঁকিবুকি। সে হিসেব এমনই তালগোল পাকানো যে, তার খেই খুঁজতে হিমসিম খাচ্ছে তৃণমূল, বিজেপি— দু’দলই। হাবডুবু খাচ্ছেন ভোটারেরাও। হিংসা এখানে নতুন নয়, সে ভোট থাক বা না-ই থাক। কিন্তু গত দু’মাসে রোজই কোথাও-না-কোথাও তৃণমূল-বিজেপির সংঘর্ষ হয়েছে। এক দলের একটা পার্টি অফিস ভাঙচুর হলে, বিপক্ষের হচ্ছে দুটো। ভোট নিয়ে এমন উন্মত্ততা, উত্তাপ আগে দেখেনি ভাটপাড়া।

গত ১৮ বছর ধরে এখানে বিধায়ক ছিলেন অর্জুন। তার আগে ১৫ বছর বিধায়ক ছিলেন তাঁর বাবা সত্যনারায়ণ সিংহ। বামেদের সঙ্গে টক্কর দিয়ে সিংহ পরিবারের পুরুষানুক্রমে ভাটপাড়ার রাশ হাতে রাখা নিয়ে তৃণমূল বা কংগ্রেসের বিশেষ আপত্তি ছিল না। সেই অর্জুন পদ্ম শিবিরে গিয়ে ঘাসবাগানে ফুল ফুটতে না-দেওয়ার চ্যালেঞ্জ ছুড়েছেন। তবে বিজেপিতে যোগ দিয়ে অর্জুন নিজে যে কণ্টকমুক্ত হতে পেরেছেন, তেমন নিশ্চয়তা তো তাঁর শিবিরে চোখে পড়ল না। কারণ, পুরনো বিজেপি কর্মীরা এত দিন অর্জুনের বিরুদ্ধে দাদাগারি-তোলাবাজির অভিযোগ করেছেন, তাঁরা কিন্তু হাত গুটিয়ে বসে নেই।

অর্জুনের সময়েই তৃণমূলের যুবনেতা হিসেবে ভাটপাড়া জুড়ে বিস্তর পরিচিতি পেয়েছিলেন প্রিয়াংগু পাণ্ডে। বছর তিনেক আগে থেকে অর্জুনের সঙ্গে ঠোকাঠুকি লাগে প্রিয়াংগুর। তাঁর নামে আচমকা আটটি কেস শুরু হয়। তার মধ্যে দু’টি খুনের। তরুণ প্রিয়াংগু গত বছর দিল্লিতে গিয়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। তিনি বলছেন, “বিজেপির প্রার্থী নিয়ে আমি কিছু বলছি না। এই বংশ পরম্পরা মানুষ কতটা মানবে, আমি জানি না। আর উল্টো দিকে তৃণমূলের প্রার্থীর নামে হাজারো বিতর্ক। মানুষ কোন দিকে যাবে ভেবে পাচ্ছে না।” যদিও এমন অভিযোগ নিজের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে উড়িয়ে অর্জুন বলছেন, ‘‘মানুষ লক্ষ্য ঠিক করে ফেলেছে। ফলে কে কী বলল, তাতে কিছু যায় আসে না।’’

বিজেপি প্রার্থী নিয়ে কিছু বলতে চান না মদনও। তিনি বলছেন, “বিজেপির প্রার্থী আমার ছেলের মতো। ওঁকে নিয়ে খারাপ কিছু বলতে আমার রুচিতে বাধে। তবে অর্জুন নিয়ে মানুষকে বলছি। ভাটপাড়ায় যদি দাদাগিরি-তোলাবাজির অবসান চান, তা হলে এই তার সুযোগ। ইতিহাস প্রমাণ যে, মদন মিত্র কখনও তাঁর ভোটারদের সঙ্গ ছাড়ে না।” কিন্তু যার তোলাবাজি নিয়ে মদন সরব, চার পক্ষকাল আগে তিনি তো তাঁরই সতীর্থ ছিলেন। মদন মানছেন সে কথা। বলছেন, ‘‘যে ঋষি এক সময় ইঁদুরকে বাঘ বানিয়েছিল, এক দিন বাঘ সেই ঋষিকেই খেতে চাইল। ফলে বাঘের ইঁদুর হওয়াটা অবশ্যম্ভাবীই ছিল। তাই হয়েছে।’’ তবে সেই অর্জুনকে টক্কর দেওয়া কি মদনের পক্ষে সম্ভব? মদন বলছেন, ‘‘অর্জুন যদি সিংহ হন, তা হলে ভাটপাড়ার বাইরে যে কোনও জায়গায় আমার সঙ্গে লড়ুন। ভাটপাড়ার মানুষ ওঁকে ছুড়ে ফেলার সুযোগ এত দিনে পেয়েছেন।’’

পবন অবশ্য সে কথা মানতে রাজি নন। মদন সম্পর্কে তিনি বলছেন, ‘‘উনি সিনিয়র মানুষ। উনি ওঁর মতো ভোট করুন। আমি আমার মতো। তবে মানুষ যাতে নিজের ভোট দিতে পারে, সেই ব্যবস্থা নির্বাচন কমিশন করুক।’’

জগদ্দল জুটমিলের উল্টো দিকে যে সরু গলি রয়েছে। তা বিজেপির ঝান্ডায় ঢাকা পড়ে গিয়েছে। সেই গলিতেই বাড়ি সিপিএমের রঞ্জিত মণ্ডলের বাড়ি। এ বারের লড়াইয়ে তিনিও রয়েছেন। তাঁর বাবা বাসুদেব মণ্ডল ভাটপাড়ার উপ-পুরপ্রধান ছিলেন। রঞ্জিত বলছেন, ‘‘ভাটপাড়ার যুব সমাজের হাতে দীর্ঘদিন চাকরি নেই। কিন্তু তাঁদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। কেন এত অস্ত্র এল। তার জবাব এ বার মানুষ সিপিএম-কে নির্বাচিত করেই দেবেন।’’

ভাটপাড়ার ১ লক্ষ ৪৮ হাজার ভোটারের ৬৮ হাজার হিন্দিভাষী। ৩৮ হাজার মুসলিম। প্রায় ৪০ হাজার বাঙালি। হিন্দিভাষী ভোটারদের ভোট এ বার কোন বাক্সে জমা পড়বে, তা নিয়ে নিশ্চিন্ত নন কেউ। অর্জুন অবশ্য বলছেন, ‘‘ভাটপাড়ার মানুষ মদন মিত্রকে ছুড়ে ফেলবেন। কারণ উনি কী করেছেন, তা রাজ্যের মানুষ জানেন।’’ তবে বিজেপি নেতারা বলছেন, পবনের লড়াই ঘরে-বাইরে। তৃণমূলের ভোট নিজের বাক্সে আনার লড়াই যেমন রয়েছে, তেমনই বিজেপির ভোটও ধরে রাখতে হবে।’’

লক্ষ্যভেদে অর্জুন কতটা ‘সফল’ হন, সেই সুতোতেই ঝুলছে পবনের ভাগ্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE