Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

হাত বাড়ালেই নবান্ন, হাওড়া তবে কত দূর!

ভোট ঘোষণার আগে গুঞ্জন থাকলেও ২০১৩ সালের উপনির্বাচন এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনে জয়ী প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়কে বদল করেননি তৃণমূলনেত্রী। কিন্তু প্রার্থীকে নিয়ে কি খুশি এলাকাবাসী?

চন্দ্রপ্রভ ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০১৯ ০৩:১৮
Share: Save:

নবান্নের ১৪তলা থেকে পশ্চিম দিকে যত দূর দেখা যায়, তত দূর ছড়িয়ে আছে হাওড়া লোকসভা কেন্দ্রটি। কিন্তু দৃষ্টি অবাধ হলেও চলতি ভোট-যুদ্ধে ততটা বাধাহীন নয় এই আসনটি। এই ময়দানে ভোট-যুদ্ধ জিততে হলে যথেষ্ট ঘাম ঝরাতে হবে সব প্রার্থীকেই।

ভোট ঘোষণার আগে গুঞ্জন থাকলেও ২০১৩ সালের উপনির্বাচন এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনে জয়ী প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়কে বদল করেননি তৃণমূলনেত্রী। কিন্তু প্রার্থীকে নিয়ে কি খুশি এলাকাবাসী?

তৃণমূলের অন্দরে কান পাতলে প্রার্থীকে নিয়ে নানা কথা শোনা যাচ্ছে। শোনা যাচ্ছে সাধারণ ভোটারদের একাংশের মুখেও। পাঁচলা, সাঁকরাইল, বালি, উত্তর হাওড়ার একাধিক এলাকায় ভোটারদের মধ্যে প্রার্থীকে নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। কেউ বলছেন, ‘‘দীর্ঘদিন প্রার্থীকে দেখা যায়নি।’’ কারও কথায়, ‘‘সামগ্রিক পরিষেবার মান উপযুক্ত নয়।’’ তবে কেউ কেউ জানাচ্ছেন, মোটের উপর প্রার্থী বা তাঁর কাজকর্মকে খারাপ বলা যাবে না। আর প্রসূনের দাবি, ‘‘মানুষের সঙ্গে প্রতিদিন ছিলাম। কাউন্সিলরের মতো দৌড়ে বেড়িয়েছি। মানুষ সন্তুষ্ট।’’

অন্য দিকে স্থানীয় নেতাদের একাংশ বলছেন, ‘‘সংগঠনের জোরেই জিতেছিলেন প্রার্থী। তারাই এখন ব্রাত্য। ফলে তাঁর হয়ে খাটতে পুরনো ছেলেদের মধ্যে অনীহা তৈরি হয়েছে।’’ এরই মধ্যে এই চর্চাকে আরও জলবাতাস দিয়ে জেলা নেতৃত্বের বার্তা, যে কাউন্সিলর যত ভাল ফল দেবেন, পরবর্তী পুরভোটে ফের মনোনয়ন পেতে তাঁর সম্ভাবনা তত উজ্জ্বল হবে। এই ওষুধে আপসে লড়াইয়ের রোগ সারবে বলেই আশা জেলা নেতৃত্বের। শাসক শিবিরের অন্দরের আরও গুঞ্জন, এই কেন্দ্রের দলীয় নেতাদের মধ্যে তালমিল তেমন একটা হচ্ছে না। যদিও দলের এক নেতার রসিক মন্তব্য, ‘‘একটাই সুবিধা, যে যে দিকেই থাকুক না কেন, সাংগঠনিক এই ভুলভুলাইয়া থেকে বেরোতে পারবে না কেউই।’’ আর প্রসূন বলছেন, ‘‘লড়াইয়ের ডাক দিয়েছেন তৃণমূলনেত্রী। সকলে তাঁর সৈনিক। ফলে কোনও ভেদাভেদ নেই।’’

দু’বছর আগে ধূলাগড়ে গোষ্ঠী সংঘর্ষ ধর্মীয় সমীকরণে কিছুটা ফাঁকফোকর তৈরি করেছে। যে ফাঁক গলে বিজেপি বিভিন্ন এলাকার নিজের শক্তি বাড়িয়েছে। মেরুকরণের বার্তা স্পষ্ট হয়েছে। তৃণমূলকেও দু’টি দিক থেকে বিজেপির মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এক, মেরুকরণের ফাঁদে কার্যত পা দিয়ে তদনুযায়ী কৌশল তৈরি করতে হচ্ছে। দুই, অবাঙালি ভোটারদের মধ্যে বাড়তে থাকা বিজেপি-প্রীতি মোকাবিলায় বিজেপির পথেই হাঁটতে হচ্ছে। যা নিয়ে খুশি নন সাবেক হাওড়ার পুরনো বাসিন্দারা। তাঁদের বক্তব্য, এই হাওড়া খুব অচেনা। তবে পুরনো হাওড়ায় মোহনবাগান-আবেগের উপস্থিতি রয়েছে যথেষ্ট মাত্রায়। ফলে পুরনো মোহনবাগানি তথা ফুটবল খেলোয়াড় প্রসূন কিছুটা বাড়তি সুবিধা যে পাবেন না, তা বলা যায় না।

এক নজরে হাওড়া
• মোট ভোটার: ১৬ লক্ষ ৩৩ হাজার ২০১ জন
• ২০১৪ সালে জয়ী তৃণমূল প্রার্থী প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়। জয়ের ব্যবধান ১ লক্ষ ৯৬ হাজার ৯৫৬।
• ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটের নিরিখে এগিয়ে তৃণমূল। মোট ৭টি বিধানসভার মধ্যে ৭টিতেই তৃণমূল জয়ী।

ধূলাগড়ের স্থানীয় একটি ছোট দোকানে উপস্থিত দুই বন্ধুর এক জন হিন্দু, অপর জন মুসলমান। অতীতের সেই ঘটনা নিয়ে যারপরনাই ক্ষোভ উগরে তাঁরা বললেন, ‘‘গরিব মানুষগুলো উপার্জন করে পরিবার প্রতিপালনের জন্য। আর কোনও দিকে নজর দেওয়ার উপায় কোথায়! সবটাই রাজনৈতিক কারণে হয়েছে। কোনও দলই দায় এড়াতে পারে না।’’

অন্য দিকে, বামপন্থী বাড়ির সন্তান তথা বিজেপি প্রার্থী রন্তিদেব সেনগুপ্ত কোন রসায়নে আরএসএস-এর ঘনিষ্ঠ হয়ে গেলেন তা নিয়ে কৌতূহল তৈরি হয়েছে পুরনো হাওড়াবাসীদের মধ্যে। যদিও রন্তিদেব বলেন, ‘‘বাড়িতে মুক্তমনা পরিবেশ বরাবরই থাকায় বাবা-মা’র সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা সম্ভব ছিল। ফলে নিজের আদর্শ স্বাধীন ভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ হয়েছে। নানা ধরনের সামাজিক কাজ করতে করতে ক্রমে এই আদর্শে আমি অনুরক্ত হয়ে পড়ি। এই লড়াইও আদর্শের।’’

একদা এখানে কংগ্রেসের জোর ছিল। পরে বামেরা শক্তিশালী হয়। ২০০৯ সাল থেকে আসনটি তৃণমূল দখলে রেখেছে। এই কেন্দ্রের সাতটি বিধানসভা দখলে রেখে ভোটের পাটিগণিতে এগিয়ে শাসক দল। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে সাতটি বিধানসভায় (বালি, হাওড়া উত্তর, হাওড়া মধ্য, শিবপুর, হাওড়া দক্ষিণ, সাঁকরাইল এবং পাঁচলা) ন্যূনতম ৩৯ এবং সর্বোচ্চ ৪৯% ভোট পেয়েছিল শাসক দল। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রগুলিতে ন্যূনতম ৪৫ এবং সর্বোচ্চ ৫৩% ভোট নিশ্চিত করেছে দল। তবে ২০১৪ সালের ভোটে তিনটি বিধানসভায় ভোট-শতাংশের হার বাড়িয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বিজেপি।

পঞ্চায়েত ভোটে জেতা প্রার্থীকে জোর করে হারিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনার অভিযোগ রয়েছে পাঁচলা, সাঁকরাইলে। যাকে হাতিয়ার করছে বিরোধীরা। পাশাপাশি সিপিএম চাইছে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া ভোটারদের ফের কাছে টানতে। দলের প্রার্থী সুমিত্র অধিকারী বললেন, “পরিস্থিতি পুরো পাল্টে গিয়েছে। মুখে যে যাই বলুক, তৃণমূলের বিরুদ্ধে যাওয়া ভোট বিজেপি পাবে না।”

একদা বন্ধ কারখানা খোলার চাবি সঙ্গে রাখার মতো দাবি না করলেও বেকারত্ব, নাগরিক পরিষেবা-সহ এলাকার সামগ্রিক উন্নতির প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে কংগ্রেস। দলের প্রার্থী শুভ্রা ঘোষ বলেন, “এলাকায় বেকারত্ব মারাত্মক। পুর পরিষেবার হালও বেহাল। মানুষ প্রতিকার চাইছেন।” আর তৃণমূল জেলা সংগঠনের আশা, এ বার কিছুটা শক্তি বাড়াবে সিপিএম। যার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে দলের ভোট বাক্সে।

হালে হাওড়া পুরসভা চত্বর পুরকর্মী বনাম আইনজীবীদের অভাবনীয় কোন্দলের সাক্ষী থেকেছে। লাগাতার প্রায় ছ’ঘণ্টার কোন্দলের ইতি হয়েছে আইনজীবীদের উপর পুলিশের প্রবল লাঠিচার্জের পরে। সামান্য স্কুটার রাখাকে কেন্দ্র করে এত বড় ঘটনা ঘটে গেল? প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক উভয় শিবিরই মনে করছে, কোন্দল আসলে তৃণমূল-বিজেপি’র ক্ষমতা ধরে রাখা আর অর্জন করার চেষ্টার মধ্যে সীমাবদ্ধ। স্কুটার পার্কিং নেহাতই প্রতীকী। তা না হলে গোলমাল থামাতে পুলিশকে কেন ঝাড়া সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা ‘অপেক্ষা’ করতে হল? কেন হঠাৎ ‘ছিঃ’ মুখোশ সেঁটে বিজেপি প্রার্থীকে শান্তির আবেদন করতে দেখা গেল?

এই আসনের পাঁচটি বিধানসভাই রয়েছে হাওড়া পুরসভার মধ্যে। পরিষেবা নিয়ে নাগরিকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। কেউ বলছেন, রাস্তা হয়েছে। অপর পক্ষ প্রশ্ন তুলছেন রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে। কারও সন্তুষ্টি পানীয় জল নিয়ে। কারও প্রশ্ন, ৩০ বছরে জল সমস্যা মেটানোই গেল না! কারও চোখ জুড়োচ্ছে এলাকাভিত্তিক সৌন্দর্যায়ন। কেউ তাকে প্রদীপের তলার অন্ধকারের সঙ্গে তুলনা করছেন। তবে বিগত পুরবোর্ডের কাউন্সিলারদেরই একাংশের ধারণা, জঞ্জাল, নিকাশি সমস্যা এবং অবৈধ নির্মাণ নিয়ে কমবেশি বিরক্ত বেশিরভাগ মানুষই। এরই সঙ্গে রয়েছে এক সময়ের এই শিল্প-জেলায় একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার দীর্ঘ ইতিহাস।

নবান্ন থাকায় অলিখিত ভাবে রাজ্যের রাজধানী এখন হাওড়াই। কিন্তু শহর জুড়ে চলতে থাকা চোরাস্রোত রাজ্যের প্রধান প্রশাসনিক ভবন পর্যন্ত পৌঁছবে কি না, তা নিয়ে জল্পনা এখন তুঙ্গে। আর সেটাই এই কেন্দ্রে ভোট-ভবিষ্যতের একটি বড় দিক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE