Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

ক্ষতে প্রলেপ! বড্ড ভয় চামেলিদের 

লক্ষ্মী মেয়ের মতো ঘাড় নাড়েন চামেলি। নির্বিঘ্নে ভোট পড়ে যায় তাঁর, এবং তাঁর মতো আরও অনেকের।

চামেলি পুরান। —নিজস্ব চিত্র।

চামেলি পুরান। —নিজস্ব চিত্র।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
দুর্গাপুর শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৯ ০৪:৪৯
Share: Save:

বুড়ি চামেলি পুরানের হাতের আঙুল নেই, পায়ের আঙুল নেই। চোখও নেই। কুষ্ঠ হয়ে খসে গিয়েছে।

তবে চামেলির ভোটার কার্ড হয়েছে অনেক দিন। প্রতি ভোটে তিনি হাতড়ে হাতড়ে গাঁয়ের বুথে যান। তখন তাঁকে দাঁড় করিয়ে ‘পার্টির ছেলেরা’ বলে, ‘‘ও ঠাগমা, তোমার তো আঙুল নেই। ভোট দিবে কী করে? আমরা ওটা দিয়ে দিচ্ছি!’’

লক্ষ্মী মেয়ের মতো ঘাড় নাড়েন চামেলি। নির্বিঘ্নে ভোট পড়ে যায় তাঁর, এবং তাঁর মতো আরও অনেকের। চেষ্টা করলে তাঁরা যে অবশিষ্ট হাত বা কব্জি দিয়ে চেপে ভোটটা দিতে পারেন না তা নয়। তবে দেন না। ভয়ে— নিজের ভোট নিজে দিলে যদি সরকারের পাঠানো সাড়ে সাতশো টাকার মাসকাবারি ডোলটা বন্ধ হয়ে যায়!

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

রাজ্যের এক পাণ্ডববর্জিত কুষ্ঠ কলোনি। বাম আমলে পুনর্বাসনের নামে মূলত দুর্গাপুর শহরাঞ্চলের কুষ্ঠরোগীদের এখানে আনা হয়। দুর্গাপুর স্টেশন থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে আশি-পঁচাশিটি ঝুরঝুরে ঘর। মুচিপাড়া থেকে এনএইচটু-র বাঁ দিকে নেমে যেতে হয় প্রায় ১৬ কিলোমিটার। লোকালয় পিছনে ফেলে দীর্ঘ ঊষর জমি, ঝোপঝাড়, ভাঙাচোরা রাস্তা পেরিয়ে বিষ পার্থেনিয়ামে ঘেরা এক চিলতে মলিন, অবহেলিত গ্রাম। কোকওভেন থানার এই কলোনির বাসিন্দাদের আধার কার্ডে এখনও ‘কুষ্ঠ আবাসন’ লেখা। তবে এখন একটা পোশাকি নাম হয়েছে কলোনির— ‘নবদিগন্ত।’ সব চেয়ে কাছের গ্রামটি ৪ কিলোমিটার দূরে। ১৫ কিলোমিটার পর্যন্ত সাইকেল আর মোটরবাইক ছাড়া কোনও যানবাহন নেই।

এখানেই বিশ-পঁচিশ বছর বসবাস চামেলি পুরান, লক্ষ্মী বাউরি, অলকা মাহাতো, চিন্তামণি টুডু, সনাতন কৈবর্ত্য, গোপাল দাস বৈরাগি, আশা ঘোষ, আদুরি মুদিদের। রয়েছেন তাঁদের ছেলেমেয়ে-নাতিনাতনি। উত্তরসূরিদের কুষ্ঠ না-থাকলেও তাঁদের পরিচয়ে রয়েছে ‘কুষ্ঠপল্লি’র ছাপ। দারিদ্রের পাশাপাশি উত্তরাধিকার সূত্রে এঁরা ভোগ করছেন কুষ্ঠরোগীদের প্রতি সর্ব স্তরের ঘৃণা এবং অবহেলা। গ্রামের বাসিন্দা প্রায় সাড়ে তিনশো, ভোটার ১৪৯ জন। এঁদের মধ্যে পরিপূর্ণ কুষ্ঠ রোগী ২৮ জন। তাঁদের হাত-পায়ের পাতা হয় নেই, নয় তো বেঁকে, মুড়ে গিয়েছে। চৈত্রের দুপুরে মাটির বাড়ির চতালে খাটিয়ায় বসে সনাতন, অনিতা, চামেলি, অলকারা বলেন, ‘‘জানেন, কোনও পার্টিই ভোট প্রচার করতে এই গাঁয়ে ঢুকতে চায় না। একে মাত্র শ’দেড়েক ভোটার, তার চেয়েও বেশি কুষ্ঠের ভয়।’’ ভোটের তাপ তাই ছড়ায় না নবদিগন্তে।

ভোটের দিন বুথ হয় গ্রামে পুরসভার প্রাথমিক স্কুলে। বাসিন্দারাই জানালেন— যে দল যখন ক্ষমতায়, তখন সে দলের ছেলেরা দাঁড়িয়ে থাকে। যে সব ভোটারের আঙুল নেই, তাঁদের ভোটটা ছেলেরাই দিয়ে দেয়। আর যাঁদের আঙুল আছে, তাঁদের পাশ থেকে বলে দেওয়া হয়, কোন বোতামটা টিপতে হবে। কেউ প্রতিবাদ করেন না। জীবনযুদ্ধেই তাঁরা রিক্ত-ক্লান্ত। গ্রামে বেশির ভাগ পরিবারের মাসিক আয় ২০০০ টাকার কম হলেও কারও বিপিএল কার্ড নেই। অলকাদের অভিযোগ, জনগণনার কাজেও সরকারি কর্মীরা গ্রামে ঢোকে না। যদি কুষ্ঠ হয়ে যায়! ফলে কুষ্ঠ রোগীদের সরকারি চিকিৎসার কোনও প্রকল্প এখানে পৌঁছয় না। নিস্পৃহ মুখে অলকা মাহাতো বলেন, ‘‘সবাই ঘেন্না করে আমাদের। কুনো মতে ভোট করিয়ে পাইলে যান বাবুরা। টিকিটুকা দেখা যায় না বাপধনেদের।’’

এই গ্রামে কেউ দু’টাকার চাল পান না, কোনও সরকারি স্কুল বা আইসিডিএস কেন্দ্র এখানে বসে না। সব চেয়ে কাছের সরকারি হাসপাতাল ২৪ কিলোমিটার দূরে। রেশন আনতে হাঁটতে হয় ১২ কিলোমিটার। অসুস্থ মানুষগুলো যাবেন কী করে? অভিযোগ, আসন্ন প্রসবাদের নিতে মাতৃযানও গ্রামে ঢুকতে চায় না। তাই বাড়িতেই হয় অধিকাংশ প্রসব। গ্রামের সুস্থ সবল ছেলেরাও বাইরে কাজ পায় না। সব চেয়ে কাছের স্কুলে যেতে প্রতিদিন আসা-যাওয়া মিলিয়ে ২০ কিলোমিটার সাইকেল টানতে হয় ছোট্ট ছেলেমেয়েগুলোকে। ক্লান্ত হয়ে তাদের অধিকাংশ কখন যেন স্কুলছুট হয়ে যায়।

এলাকার পাঁচ বছরের সাংসদ তৃণমূলের মমতাজ সংঘমিতা এ বারও প্রার্থী। স্বীকার করলেন, কুষ্ঠ গ্রামে কখনও যাওয়া হয়নি। গ্রামের মানুষের এমন অবস্থা এবং অপ্রাপ্তির কথাও তিনি জানেন না। বললেন, ‘‘মানছি আমার অজ্ঞতাটা অনভিপ্রেত। কিন্তু তাঁদের কথা আমাকে কেউ সে ভাবে জানাননি। আমি তো ডাক্তার। জানলে ঠিক যেতাম। এ বারে যাব।’’ ভোটে তাঁর মূল প্রতিদ্বন্দ্বী সিপিএমের আভাস রায়চৌধুরীর কথায়, ‘‘মানুষ সুযোগ দিলে সাংসদ হয়ে ওঁদের সব সমস্যার সমাধান করব।’’

নবদিগন্তের বাসিন্দাদের অবশ্য তাতে বিশেষ তাপ-উত্তাপ নেই। তাঁরা ব্যস্ত প্রতিদিন পেট ভরাতে। গ্রামবাসীদের মূল পেশা ভিক্ষে করা। বুধ-শুক্র-শনি-রবি— এই চার দিন দল বেঁধে তাঁরা ভিক্ষা করতে যান দুর্গাপুরে। সূর্য ওঠার আগে বেরোতে হয়। আঙুল খসে গুটিয়ে যাওয়া পা টেনে ১৩ কিলোমিটার পেরিয়ে দুর্গাপুর স্টেশনে যেতে সময় লাগে বহু। একই ভাবে দিনের শেষে ফিরে আসা। ৫০ থেকে ৭০ টাকা রোজগার দৈনিক। যে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বেশ কিছু দিন ধরে এই গ্রামে উন্নয়নমূলক কাজ করছে, তার কর্মী কাননগোপাল পাত্র বলছিলেন, ‘‘আমরা ওঁদের চিকিৎসা করতে চাইলেও ওঁরা রাজি হন না। পাছে ক্ষত সেরে গেলে ভিক্ষে পাওয়া বন্ধ হয়! কারও ক্ষত সেরে গেলে সেখানে গুড়-জলে ভেজানো কাপড় বেঁধে ভিক্ষায় বের হন। গুড়-জলে মাছি বসবে। দেখে লোকে পয়সা দেবে!’’

ক্ষতে প্রলেপ পেতে বড় ভয় যে অলকা-চামেলিদের!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE