Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

‘সিংহের পাড়া’য় কোণঠাসা মদন

কোথাও মদনকে ঘেরাও করে মারধরের চেষ্টা চলল, বিক্ষোভ হটাতে লাঠিও চালানো হল। কোথাও তাঁর গাড়ির সামনেই ছোড়া হল বোমা। এত কিছু সত্ত্বেও সারা দিন ধরে অলিগলি থেকে রাজপথে চরকি পাক খেয়ে অশান্তি রোখার মরিয়া চেষ্টা চালালেন প্রাক্তন পরিবহণমন্ত্রী।

ভাটপাড়া উপনির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থী মদন মিত্রের সঙ্গে বচসা। রবিবার কাঁকিনাড়ায়।  (ডান দিকে)  ভাটপাড়ায় নিজের অফিসে আইসক্রিমে কামড় অর্জুন সিংহের। ছবি: দেবরাজ ঘোষ ও দীপঙ্কর মজুমদার।

ভাটপাড়া উপনির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থী মদন মিত্রের সঙ্গে বচসা। রবিবার কাঁকিনাড়ায়। (ডান দিকে) ভাটপাড়ায় নিজের অফিসে আইসক্রিমে কামড় অর্জুন সিংহের। ছবি: দেবরাজ ঘোষ ও দীপঙ্কর মজুমদার।

শান্তনু ঘোষ ও সুপ্রকাশ মণ্ডল
ভাটপাড়া শেষ আপডেট: ২০ মে ২০১৯ ০২:৩৮
Share: Save:

বিধানসভা উপনির্বাচনের প্রচারে ভাটপাড়ার ‘সিংহ’-কে এলাকা ছাড়া করার আগাম হুমকি দিয়ে রেখেছিলেন তিনি। কিন্তু ভোটের দিন বিভিন্ন রকমের অশান্তি পাকিয়ে সেই মদন মিত্রকে কার্যত কোণঠাসা করে রাখার অভিযোগ উঠল তাঁরই এক সময়ের সতীর্থ তথা বিজেপির সাংসদপদ প্রার্থী অর্জুনের বিরুদ্ধে।

কোথাও মদনকে ঘেরাও করে মারধরের চেষ্টা চলল, বিক্ষোভ হটাতে লাঠিও চালানো হল। কোথাও তাঁর গাড়ির সামনেই ছোড়া হল বোমা। এত কিছু সত্ত্বেও সারা দিন ধরে অলিগলি থেকে রাজপথে চরকি পাক খেয়ে অশান্তি রোখার মরিয়া চেষ্টা চালালেন প্রাক্তন পরিবহণমন্ত্রী।

রবিবার সকালে ইস্ট ঘোষপাড়া রোডের বাবু কোয়ার্টার্স এলাকায় তৃণমূল কার্যালয়ে বসে মদন বলেছিলেন, ‘‘অর্জুনের একমাত্র কাজ, ভোট নষ্ট করবে। ওকে সময় দিচ্ছি, না-হলে বাধ্য হয়ে মোকাবিলায় যেতে হবে।’’ তত ক্ষণে বিভিন্ন জায়গা থেকে দলীয় এজেন্টদের বার করে দেওয়া, ভোটদানে বাধাদানের খবর এসে পৌঁছতে শুরু করেছে মদনের কাছে। সব শুনে আর দেরি না-করেই সকাল পৌনে ৯টা নাগাদ নিরাপত্তারক্ষী এএসআই প্রদীপ আঢ্য ও নির্বাচন কমিটির আহ্বায়ক সোমনাথ শ্যামকে নিয়ে ভাটপাড়ার রাস্তায় গাড়ি ছোটালেন মদন। রাস্তায় পুজো দিলেন গোলঘর কালীমন্দিরে।

ভোট শুরুর ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই বিরোধীদের দিকে মদন যখন অভিযোগের আঙুল তুলছেন, তখন ভাটপাড়া ও নৈহাটির সীমানা এলাকায় পরিচিতের বাড়িতে থিতু হয়েছেন অর্জুন। সকাল ৭টায় বাড়ির সামনের বুথে ভোট দিয়ে সটান সেখানে চলে এসেছেন তিনি। দু’টি ফোন তুলে ঠান্ডা মেজাজে কর্মীদের ভোটটা ঠিকঠাক করার নির্দেশ দিয়েছেন। তারই মধ্যে সকাল সাড়ে ৮টা নাগাদ আচমকাই মেজাজ হারান অর্জুন। বলেন, ‘‘কয়েকটা বুথে বিজেপি ভোটারদের ভোট দিতে বাধা দিচ্ছে তৃণমূল।’’ পরক্ষণেই ফোন করে হুমকি দিলেন পুলিশকে।

পুজো সেরে মদন অবশ্য তখনই ঘুরে ফেলেছেন লেবার ওয়েলফেয়ার প্রাথমিক বিদ্যালয়, আর্যসমাজ মন্দির, শিশু বিকাশ বিদ্যালয়-সহ কয়েকটি ভোটগ্রহণ কেন্দ্র। সব দেখে বেরোনোর সময় মদন বললেন, ‘‘একে তীব্র গরম, তার সঙ্গে বিজেপির সন্ত্রাসে ভোটদানের শতকরা হার খুব কম। এগুলি তো নির্বাচন কমিশনের দেখার কথা। কিন্তু তাঁরা কিছুই করছেন না। মানুষ এর উত্তর দেবেন।’’ সকাল ৯টাতেই খাঁ-খাঁ রোদ। উপেক্ষা করেই অনেকটা পথ হেঁটে মদন পৌঁছলেন শিশু বিকাশ বিদ্যালয়ে।

সেখানে ‘দাদা’র কাছে রবিরঞ্জন সিংহ নামে এক এজেন্ট অভিযোগ করলেন, তাঁকে বুথ থেকে বার করে দেওয়া হয়েছে। ওই এজেন্টকে নিয়ে লেবার ওয়েলফেয়ার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পৌঁছে গেলেন মদন। বুথে ঢুকে সরাসরি প্রিসাইডিং অফিসারের কাছে জানতে চাইলেন, ‘কেন এজেন্টকে বার করে দিয়েছেন? আপনার নাম বলুন।’’ সেখানেই মদনকে বুথে ঢুকতে বাধা দেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর এক জওয়ান। তাতে মেজাজ হারিয়ে তিনি বলেন, ‘‘রাজ্য কেন্দ্র বুঝি না। আমি বুঝি শুধু মডেল কোড অব কন্ডাক্ট। সেটা সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।’’ রবিরঞ্জনকে ফের বুথে বসিয়ে অন্য পথে গাড়ি ছুটল মদনের।

অন্য দিকে, পরিচিতের বাড়িতে বসে তখন ছেলে পবনের জয় নিয়ে নিশ্চয়তা প্রকাশ করে জয়ের ব্যবধান নিয়ে চিন্তা করছেন অর্জুন। তার মধ্যেই পুলিশ এসে তাঁকে জানিয়ে দেয়, তিনি যেখানে আছেন, সেখানেই যেন থাকেন। অযথা যেন ঘোরাঘুরি না-করেন। অর্জুন বলেন, ‘‘কিছু ঘটলে আমি আপনাদের কাছে ১০০ বার অভিযোগ করব। তাতে কাজ না-হলে ১০১ বার আমি যাব।’’ হাসিঠাট্টার মধ্যে মদনকেও বিঁধতে ছাড়েননি অর্জুন। বলেছেন, ‘‘মদন কে? মদন কী বলবে, তা শুনে চলতে হবে! ভাটপাড়া আমার মাটি। আমি ঠিক করব...।’’

কাঁকিনাড়া হাইস্কুলে পৌঁছে মদন দাবি করলেন, সেখানে সব ঠিক নেই। অভিযোগ তুললেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে। আর তা নিয়েই বচসায় জড়ালেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর সঙ্গে। মদন যখন সেখানে রয়েছেন, তখনই এক ব্যক্তির ভোট পড়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। বিষয়টি ঘিরে প্রিসাইডিং অফিসারের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন মদন। বলেন, ‘‘পোলিং অফিসার বলছেন, প্রিসাইডিং অফিসার জানেন। আর উনি বলছেন বিজেপি এজেন্ট বলেছেন। কেন্দ্রীয় বাহিনীও বুথে ঢুকে হুমকি দিচ্ছে। পুরোটাই পরিকল্পনামতো হচ্ছে।’’

এত ক্ষণ মেজাজ ফুরফুরে থাকলেও কাঁকিনাড়া বাজারের হিন্দি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেতেই মেজাজ সপ্তমে চড়ে যায় মদনের। সেখানে কেন্দ্রীয় বাহিনী তাঁকে বুথে ঢুকতে বাধা দেয়। বাহিনীর উদ্দেশে মদন বলেন, ‘‘মত ডরাও, মত চমকাও। মারবে তো মেরে দাও।’’ পরে তিনি আরও বলেন, ‘‘খেলা তো শেষ নয়। আজ তো খেলা শুরু।’’ সেই কথাই বোধ হয় অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল ঘণ্টাখানেকের বিরতি নিয়ে ফের রাস্তায় বেরোতেই। তত ক্ষণে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে মদনের নিরাপত্তা বেড়েছে। তা নিয়ে ফের কাঁকিনাড়া হাইস্কুলে গেলেন তিনি।

সেখানে গেটের বাইরে লাইনে দাঁড়ানো কয়েক জন মহিলা-পুরুষ প্রশ্ন তুললেন, কেন বারবার সেখানে এসে অশান্তি করছেন মদন? স্কুল থেকে রাস্তায় বেরোতে আচমকাই তাঁর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েন কিছু বিজেপি-কর্মী। শুরু হয় বিক্ষোভ। মদনকে মারধরের চেষ্টা করতেই তা রুখে দেন নিরাপত্তারক্ষীরা। শেষে কেন্দ্রীয় বাহিনী লাঠি চালিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পরে মদন বলেন, ‘‘ও (অর্জুন) যত ক্ষণ চুপ থাকবে, আমিও থাকব। তবে খবর আসছে। ও শুরু করলে আমিও রুখব।’’

তার পরেই কাঁটাপুকুর এলাকায় পৌঁছন মদন। সেখানকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলা সামনে এগোতেই আচমকা মদনের গাড়ি লক্ষ্য করে ছোড়া হতে থাকে বোমা। চলে গুলিও। কোনও মতে নিরাপত্তারক্ষী তাঁকে এলাকার একটি ধর্মীয় স্থানের সামনে নিয়ে যান। অন্য দিকে, ইস্ট ঘোষপাড়া রোডেও তখন শুরু হয়েছে ইট ছোড়াছুড়ি। বেশ কিছু ক্ষণ সেখানে কাটানোর পরে বেরিয়ে পড়েন মদন। তাঁর অভিযোগ, বোমা মেরে বেশ কয়েকটা বুথ দখল করে সেখানে নির্লজ্জের মতো ভোট করেছেন অর্জুন। এমনকি ভোট শেষ হওয়ার পরে তৃণমূলের এজেন্টদের দরজা বন্ধ করে মারধর করেছে কেন্দ্রীয় বাহিনী। রাতে বিভিন্ন এলাকায় বোমাবাজিও করে বিজেপি-কর্মীরা।

মদন বলেন, ‘‘যদি কেন্দ্রীয় বাহিনী নির্লজ্জের মতো অর্জুনের উঞ্ছবৃত্তি না-করত, তা হলে আজকের চিত্রটাই বোধ হয় সম্পূর্ণ আলাদা হত।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE