বেলেঘাটা থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত মিছিলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি রয়টার্স।
সুবিশাল রোড শো-কে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছিল ধুন্ধুমারটা। তার পর টানা ২৪ ঘণ্টা চড়া সুরে আক্রমণ বহাল রেখে সুবিশাল মিছিলের মাধ্যমেই বৃত্ত সম্পূর্ণ করার চেষ্টা করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
কণ্ঠস্বর কতটা তুঙ্গে তুলবেন তিনি বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা নিয়ে, তার আভাসটা বেহালা এলাকার একটি জনসভা থেকে মঙ্গলবার সন্ধ্যায়ই দিয়ে দিয়েছিলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল চেয়ারপার্সন। বুধবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সেই আঁচটাই অনুভূত হল গোটা বাংলায়। দিল্লিতে বসে আক্রমণের সূচনাটা করলেন ডেরেক ও’ব্রায়েন। একটু বেলায় পার্থ চট্টোপাধ্যায় একই ভাবে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠলেন কলকাতায় সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে। বিকেলে বেলেঘাটার গাঁধী ভবন থেকে শ্যামবাজারের নেতাজি মূর্তি পর্যন্ত বিশাল মিছিল করে বৃত্ত সম্পূর্ণ করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
বুধবার দুপুরে নয়াদিল্লিতে কনস্টিটিউশন ক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলন করেন রাজ্যসভায় তৃণমূলের দলনেতা তথা জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েন। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কলকাতায় বিদ্যাসাগর কলেজে কী ঘটেছিল, তার কিছু ভিডিয়ো ফুটেজ তিনি তুলে ধরেন দেশের মিডিয়ার সামনে এবং দাবি করেন, অমিত শাহের রোড শো থেকে বিনা প্ররোচনায় ওই কলেজে হামলা চালিয়েছে বিজেপি এবং ভেঙেছে বিদ্যাসাগরের মূর্তি। তিনি যে ভিডিয়োগুলো দেখাচ্ছেন, সেগুলোর মাধ্যমে তিনি কোনও অভিযোগ করছেন না, তিনি অকাট্য প্রমাণ তুলে ধরছেন— ডেরেক এমনই বলেন। অমিত শাহকে ‘মিথ্যাবাদী’ বলে এ দিন আক্রমণ করেন তিনি।
আরও পড়ুন: দেশে প্রথম ৩২৪ ধারা প্রয়োগ! রাজ্যে কালই শেষ ভোটপ্রচার, অপসারিত স্বরাষ্ট্রসচিব ও রাজীব কুমার
বুধবার সকালে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহও দিল্লিতে সাংবাদিক বৈঠক করেন। কী ভাবে তাঁর রোড শোয়ে হামলা চালানো হয়েছিল। কী ভাবে নিরাপত্তারক্ষীরা আড়াল করে তাঁকে রক্ষা করেছিলেন— ছবি দেখিয়ে তা বোঝানোর চেষ্টা করেন অমিত শাহ। প্রথমে রোড শো শুরুর আগে ফ্লেক্স-ব্যানার খুলে নেওয়া, পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের সামনে গোলমাল এবং শেষে বিদ্যাসাগর কলেজের সামনে হিংসাত্মক পরিস্থিতি— এই তিন ঘটনার কথা তুলে ধরে অমিত শাহ এ দিন অভিযোগ করেন যে, তিন দফায় তাঁর রোড শোয়ে তৃণমূল হামলা করেছে মঙ্গলবার। কিন্তু তাতেও যখন লাভ হয়নি, তখন নিজেরা বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙে তার দায় বিজেপির ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা শুরু করেছে তৃণমূল— দাবি করেন বিজেপি সভাপতি। সে প্রসঙ্গেই বিজেপি সভাপতিকে আক্রমণ করেন ডেরেক এবং বলেন যে, দিল্লিতে বসে উনি এখন মঙ্গলবারের ঘটনার বিষয়ে নানা যুক্তি সাজানোর চেষ্টা করছেন।
আরও পড়ুন: বিদ্যাসাগর মূর্তি ভাঙা নিয়ে অমিত শাহের সমর্থনে একটি কথাও বললেন না মোদী
এতেই থামেনি তৃণমূল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পথে না নামা পর্যন্ত মূর্তিভঙ্গ কাণ্ডের রেশ বহাল রাখতে সব রকম ভাবে দিনভর তৎপর ছিল বাংলার শাসক দল। নয়াদিল্লিতে ডেরেকের সাংবাদিক সম্মেলন হয়ে যাওয়ার ঘণ্টাখানেক পরে কলকাতায় সাংবাদিক সম্মেলন ডাকেন তৃণমূল মহাসচিব তথা রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তিনিও বেশ কিছু ভিডিয়ো ফুটেজ তুলে ধরে আঙুল দিয়ে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেন যে, বিদ্যাসাগর কলেজে যাবতীয় অশান্তির হোতা বিজেপি কর্মীরাই। বিজেপি বাইরে থেকে লোক এনে তাণ্ডব চালিয়েছে বলেও তিনি দাবি করেন।
তবে মূর্তিভঙ্গ কাণ্ডে তৃণমূলের সবচেয়ে বড় কর্মসূচিটা শুরু হল বিকেলে। তার আগে সকাল থেকেই জেলায় জেলায় ‘ধিক্কার মিছিল’ করছিল তৃণমূল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও উত্তর ২৪ পরগনার আগরপাড়ার জনসভা থেকে সে প্রসঙ্গে তীব্র আক্রমণ করেছিলেন বিজেপি-কে। কিন্তু বিকেল ৫টা ৪১ মিনিটে তিনি বেলেঘাটার গাঁধী ভবন থেকে মিছিলটা শুরু করলেন এবং সে মিছিল অঘোষিত ভাবে হয়ে উঠল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শক্তি প্রদর্শনের কর্মসূচি। শুধু ভিড় টানার নিরিখে নয়, বাংলার শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক কর্মীদের মধ্যে তাঁর শিকড় কতখানি গভীর, তার নিরিখেও নিজের সক্ষমতাটা বিজেপি-কে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী।
বেলেঘাটা থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত মিছিল একাধারে ছিল বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙাকে ধিক্কার জানানোর মিছিল, অন্য দিকে তা ছিল উত্তর কলকাতার তৃণমূল প্রার্থী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমর্থনেও। অতএব সুদীপ নিজে তো উপস্থিত ছিলেনই, ছিলেন তাঁর স্ত্রী তথা চৌরঙ্গির বিধায়ক নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়, বেলেঘাটার বিধায়ক পরেশ পাল, জোড়াসাঁকোর বিধায়ক স্মিতা বক্সী, শ্যামপুকুরের বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী শশী পাঁজা, কলকাতার মেয়র তথা রাজ্যের পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, ডেপুটি মেয়র অতীন ঘোষ, মেয়র পারিষদ দেবাশিস কুমার, বেশ কয়েকটি বরোর চেয়ারম্যানরা এবং তৃণমূলের কাউন্সিলররা। কিন্তু এঁরা সামনে ছিলেন না এ দিনের মিছিলে। বিদ্যাসাগারের মূর্তি ভাঙার প্রতিবাদের কথা মাথায় রেখে মিছিলের পুরোভাগে রাখা হয়েছিল শুভাপ্রসন্ন, জয় গোস্বামী, নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি, শাঁওলি মিত্র, আবুল বাশার, সুবোধ সরকার, দেবেশ চট্টোপাধ্যায়, অভীক মজুমদারদের। তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন গাড়িতে। আর তাঁদের বেশ কিছুটা পিছনে হাঁটছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যাঁর পিছনে বিরাট মিছিল আর দু’ধারে অপেক্ষমান স্থানীয় জনতা।
গাঁধী ভবন থেকে ফউলবাগান, কাঁকুড়গাছি, বাগমারী, মানিকতলা, বিবেকানন্দের ভিটে হয়ে শ্যামবাজার পর্যন্ত যান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বেলেঘাটা, মানিকতলা, জোড়াসাঁকো, শ্যামপুকুর— এই চারটি বিধানসভা কেন্দ্র ছুঁয়ে যায় তাঁর মিছিল। রাস্তার দু’ধারে অনেক এলাকাতেই লাল-পাড় সাদা বা জোড়াফুল আঁকা শাড়ি পরে অপেক্ষায় ছিলেন দলের মহিলা কর্মীরা। অনেক এলাকাতেই শঙ্খধ্বনিতে স্বাগত জানান তাঁরা নেত্রীকে। গোটা যাত্রাপথ সাজানো ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফ্লেক্সে-ব্যানারে। আর ছিল ‘ছিঃ’ লেখা ব্যানার— বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙাকে ধিক্কার জানাতে।
মঙ্গলবার অমিত শাহ যে রোড শো কলকাতায় করেন, তাতে হওয়া সমাগম অনেককেই চমকে দিয়েছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুর্গ কলকাতায় বিজেপি এমন চোখ ধাঁধানো রোড শো করতে পারে— অনেকেরই কল্পনায় তা ছিল না মঙ্গলবারের আগে। কিন্তু বিজেপির কর্মসূচি মঙ্গলবার যে আকারই নিক, কলকাতার রাজপথে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদযাত্রাকে ম্লান দেখানোর মতো পরিস্থিতি যে এখনও একটুও তৈরি হয়নি, তা বুধবার বেশ বুঝিয়ে দিয়েছেন তৃণমূল চেয়ারপার্সন।
বিরাট মিছিল সঙ্গে নিয়ে সন্ধ্যা ৭টা ১৭ মিনিট নাগাদ শ্যামবাজারে পৌঁছন মুখ্যমন্ত্রী। ৭টা ১৯ পাঁচমাথা ছেড়ে রওনা হয়ে যায় তাঁর কনভয়। নেত্রীর গতির সঙ্গে তাল মেলাতে হিমশিম খেয়ে যাওয়া নেতা-মন্ত্রীরাও একে একে উঠে পড়েন গাড়িতে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy