Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
general-election-2019-journalist

নশিপুর-আজিমগঞ্জ রেল সেতুর নসিব বদলাবে কে? জানতে চাইছে মুর্শিদাবাদ

ভাগীরথীর পাড়ে নবাবি স্থাপত্য আর ঘোড়ার খুরের টগবগে শব্দে লালবাগের অলিগলি যেন এখনও কথা বলে। হাজারদুয়ারির গেট তখনও খোলেনি। কিন্তু তাতে কী? সাত সকালে টাঙ্গাগাড়িতে চড়ে বেরিয়ে পড়েছেন পর্যটকেরা

নশিপুর আজিমগঞ্জ রেল সেতুর জমিদাতারা।

নশিপুর আজিমগঞ্জ রেল সেতুর জমিদাতারা।

সোমনাথ মণ্ডল
মুর্শিদাবাদ শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৯ ১৬:০৮
Share: Save:

ভাগীরথীর পাড়ে নবাবি স্থাপত্য আর ঘোড়ার খুরের টগবগে শব্দে লালবাগের অলিগলি যেন এখনও কথা বলে। হাজারদুয়ারির গেট তখনও খোলেনি। কিন্তু তাতে কী? সাত সকালে টাঙ্গাগাড়িতে চড়ে বেরিয়ে পড়েছেন পর্যটকেরা। মুর্শিদাবাদ মানেই তো ইতিহাসকে ছুঁয়ে দেখা।

এই হাজারদুয়ারির অদূরেই নশিপুর-আজিমগঞ্জ রেল সেতুও বোধহয় নবাবি স্থাপত্যের মতো ‘ইতিহাস’ হয়ে যেতে বসেছে। ১৫ বছর ধরে জট খোলার নাম নেই। পর্যটনের আড়ালে এমনই নানা সমস্যায় জর্জরিত মুর্শিদাবাদের মানুষ। তা সে পদ্মপাড়ের ভাঙনই হোক বা আন্তর্জাতিক সীমানার সমস্যা— মুর্শিদাবাদ আছে মুর্শিবাদাবাদেই।

রেলকে প্রায় জলের দরে বাড়ি-ঘর সমেত বাস্তু জমি দিয়েছিলেন নৃসিংহ মণ্ডলের মতো কয়েকশো মানুষ। চোখের সামনে নদীতে সেতু তৈরি হয়েছে। কিন্তু ট্রেন চালু হয়নি। এক নিশ্বাসে মনে জমে থাকা ক্ষোভ উগরে দিয়ে নৃসিংহ বললেন, “ভোট আসে ভোট যায়, সমস্যার সমাধানে উদ্যোগী হয় না কোনও দলই। এখানে শুধু ভোটের রাজনীতি হয়।”

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

ভাগীরথীর উপরে সেই রেল সেতু।

‘‘হঠাৎ রেল সেতুর খোঁজ নিচ্ছেন কেন?’’—নৃসিংহ এ বার প্রশ্ন করে বসলেন। জবাবের জন্য অপেক্ষা করলেন না। নিজেই বলতে শুরু করলেন, “দেখতে দেখতে ১৫ বছর হয়ে গেল জমি জটে আটকে রয়েছে প্রকল্পটি। তিন কাঠা জমি মাত্র এক লাখ ৬৯ হাজারে রেলকে দিতে হয়েছে। আমার মতো অনেকেই জমি দিয়েছেন। কিন্তু সব বিষয়েই রাজনীতি ঢুকে যায়।”

আরও পড়ুন: ধুঁকছে ‘সিল্কের মক্কা’, এনআরসি নিয়ে তপ্ত জঙ্গিপুরের মাটি​

কিসের রাজনীতি?

নৃসিংহের ভাই বীরসিংহ পাশেই থাকেন। দাদার কথাগুলো হাঁ করে শুনছিলেন। এ বার বীরসিংহ ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, “আগে আপনাকে তো জানতে হবে, এই সেতু হলে কী সুবিধা হত?’’

আরও পড়ুন: দূষণ দেখে বিরক্ত ‘তারকা’ মুনমুন, বাবুলের আসল প্রতিদ্বন্দ্বী ‘মেয়র সাহেব’

জানতে চাইলাম, কিসের সুবিধা? এ বার তিনি বললেন, ‘‘তা হলে শুনুন, ভাগীরথীর পশ্চিম পাড়ে পূর্ব রেলের হাওড়া এবং মালদহ ডিভিশনের রেলপথ। আর পূর্ব দিকে শিয়ালদহ ডিভিশনের একটি লাইন গিয়েছে বহরমপুর হয়ে লালগোলায়। নদীর দু’পাশ দিয়েই রেল লাইন রয়েছে, অথচ একে অপরের সঙ্গে যোগ নেই। সেই নৈহাটি-ব্যান্ডেলে দুই ডিভিশন জুড়েছে।”

এত ক্ষণ দাঁড়িয়েই কথা হচ্ছিল। এ বার চেয়ার এল। খোকন স্থানীয় যুবক, তিনি বীরসিংহের কথা থামিয়ে বললেন, “দাদা, যাঁরা নিত্য যাতায়াত করেন, তাঁরা এই সমস্যার কথা বুঝবেন। দিল্লি বা উত্তর-পূর্ব ভারতের ট্রেন ধরতে গেলে আমাদের হাওড়া অথবা শিয়ালদহে যেতে হয়। সে জন্যেই তো নশিপুর-আজিমগঞ্জ রেল সেতু তৈরি করে মুর্শিদাবাদে দুই ডিভিশনের মধ্যে সংযুক্তির চেষ্টা হয়েছিল।”

আরও পড়ুন: লাইভ: ঝড়বৃষ্টিতে ফসলের ক্ষতি হলে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে, রায়নায় সভায় বললেন মমতা

ভাগীরথীর পূর্ব পাড়ে নশিপুর এবং পশ্চিম পাড়ে আজিমগঞ্জের মধ্যে রেল সেতু নির্মানও হয়ে গিয়েছে। তা দেখাও যাচ্ছে। জানতে চাইলাম, কোথায় সমস্যা? খোকন বললেন, “সেতুর দু’পাশের জমিতে রেললাইন পাতা নিয়েই তো যত সমস্যা। নশিপুরের অধিকাংশ মানুষ জমি দিয়ে দিয়েছেন। আজিমগঞ্জের বাসিন্দারা জমি দিলেও, প্রত্যেকে চাকরির দাবি করেছেন। প্রত্যেকই বিভিন্ন দল করেন। বড় নেতাদের মাথার খেলা তো এখানেই। তাঁদের কথা শুনে আজিমগঞ্জের বেশ কয়েকটি পরিবার চাকরির লোভে, একটা জমিকেই কয়েক ভাগ করে, পরিবারের তিন ছেলের নামে নামে রেজিস্ট্রেশন করে দিয়েছে। ফলে যে জমির পরিবর্তে একটা চাকরি হত, এখন রেলকে ওই একই জমিতে তিন জনের চাকরির জন্যে চাপ দেওয়া হচ্ছে। এ রকম অনেক কেস আছে।”

আরও পড়ুন: ধুঁকছে ‘সিল্কের মক্কা’, এনআরসি নিয়ে তপ্ত জঙ্গিপুরের মাটি

গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথাবার্তায় উঠে এল ২০০৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় এবং রেলমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব এই প্রকল্পের শিলান্যাসের বিষয়টি। পরে বহরমপুরের সাংসদ অধীর চৌধুরী ব্যক্তিগত চেষ্টায় সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছিলেন বলেও তাঁরা জানালেন। তাঁদের বক্তব্য, অন্য দলের স্থানীয় নেতারা ভোটের লোভে, সমস্যা আরও জটিল করে তুলেছে। তার জের এখনও পোহাতে হচ্ছে মুর্শিদাবাদ-সহ গোটা বাংলাকেই!

মুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্রে সিপিএম প্রার্থী বদরুদ্দোজা খান। তিনি এখানকার বিদায়ী সাংসদও বটে। এলাকার লোকজন বলছেন, ‘‘ওঁকে গত পাঁচ বছরে কাছেই পাইনি। কাকে বলব? নশিপুর-আজিমগঞ্জ রেল সেতুর নসিব বদলাবে কে?’’

ইতিহাসের শহরে মঙ্গলবার ভোট।

মুর্শিদাবাদের ভাগ্য ঝুলছে এই সেতুর উপরেই। সেতু দিয়ে ট্রেন চলাচল শুরু হলে এখানকার অর্থনৈতিক উন্নতি, পর্যটনের প্রসার, যাতায়াত ব্যবস্থার ভোল বদলে যাবে। তাই শুধু জমি দাতারাই নন, বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ এবং জঙ্গিপুর লোকসভা কেন্দ্রের ভোটদাতারাও এ নিয়ে সরব।

১৯৮০ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত এই কেন্দ্র সিপিএমের দলখলেই ছিল। মাঝে দু’বার কংগ্রেসের দখলে, তার পর ২০১৪ সালে ফের সিপিএম। অধীর ঘনিষ্ঠ কংগ্রেস প্রার্থী আবু হেনা সিপিএমের কাছে কঠিন চ্যালেঞ্জ। বহরমপুরে অধীরের বিরুদ্ধে সিপিএম প্রার্থী না দিলেও, অধীরের কথাতেই এখানে কংগ্রেস প্রার্থী দিয়েছে। তৃণমূলের আবু তাহের খান অথবা ‘দলবদলু’ বিজেপির হুমায়ুন কবীরও লড়াইয়ের ময়দানে রয়েছেন। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল ভাল ভল করেছে, সেটাই চিন্তার কারণ সিপিএম এবং কংগ্রেসের। লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত ৫ বিধানসভাই আবার তৃণমূলের। দু’টি সিপিএমের। একটি কংগ্রেস। বিজেপি প্রার্থী দিলেও, মুর্শিদাবাদে ত্রিমুখী লড়াইয়ে কে মুর্শিদাবাদের ‘নবাব’ হন, সেটাই এখন দেখার।

ছবি: প্রতিবেদক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE