Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
general-election-2019-journalist

ভোটের শহরে জ্বলছে বেচাকেনার আলো

‘‘স্বপ্নরাজ্য বাঁচবে তো? সব ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যেতে হবে না তো?’’ প্রশ্নগুলো তাড়া করে ফিরছে নাসিফার মতো আরও অনেককে।

নাখোদা মসজিদের ইমাম মৌলানা মহম্মদ শফিক কাসমি। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

নাখোদা মসজিদের ইমাম মৌলানা মহম্মদ শফিক কাসমি। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

স্যমন্তক ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ মে ২০১৯ ০৩:৪৪
Share: Save:

চুন চুন কে হম নিকাল দেঙ্গে।

টেলিভিশন সেটে গেরুয়া দলের এক নেতার মুখে কথাগুলো শোনা ইস্তক আক্ষরিক অর্থেই ঘুম ছুটেছে তাঁর। ‘‘সত্যি বার করে দেবে না তো?’’ সন্ত্রস্ত অপলক দৃষ্টিতে সাংবাদিকের চোখে চোখ রাখলেন নাসিফা বেগম।

পার্ক সার্কাসের এই অঞ্চলে অসংখ্য নাসিফার বসবাস। সময়ের বিভিন্ন পর্বে বিহার এবং লাগোয়া উত্তরপ্রদেশ ছেড়ে কাজের খোঁজে কলকাতায় চলে এসেছেন তাঁরা। দেশে তাঁদের ঘর আছে। খেত আছে। মানি অর্ডারে টাকা পাঠানো আছে। কিন্তু মনে প্রাণে তাঁরা কলকাতার। বিশ্বাস করেন, কলকাতাই তাঁদের ‘খোয়াইশ’ মেটানোর ‘স্বপ্নরাজ্য’।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

‘‘স্বপ্নরাজ্য বাঁচবে তো? সব ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যেতে হবে না তো?’’ প্রশ্নগুলো তাড়া করে ফিরছে নাসিফার মতো আরও অনেককে। যবে থেকে তাঁরা শুনতে শুরু করেছেন, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের কথা। সে বিলে কী আছে তাঁরা জানেন না। তবু ভয়, মুসলিমদের পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। ‘‘টেলিভিশনে সে কথাই তো বলছেন একটা দলের নেতারা। উত্তরপ্রদেশ, গুজরাতের অবস্থা দেখেছেন?’’

বেগে কথা বলতে বলতে নাসিফা ঢুকলেন আব্বার কাছে শোনা গল্পে— দেশ ভাগের কিছু পরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় উত্তরপ্রদেশে তাঁদের গ্রামের বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল পাকিস্তানে চলে যেতে। পরিবার নিয়ে নাসিফার দাদু চলে এসেছিলেন কলকাতায়। একটাই বিশ্বাসে, সারা দেশে যা-ই ঘটে যাক, বাংলায় তাঁরা নিরাপদ।

অথচ সেই বাংলায়, সেই কলকাতায়, সেই প্রাণের পার্ক সার্কাসে ইদানীং ভয় পাচ্ছেন আবরার আহমেদ। গালিব-ভক্ত ট্যাক্সি ড্রাইভার সওয়ারিদের মধ্যে স্পষ্ট মেরুকরণ দেখতে পাচ্ছেন। বুঝছেন, গেরুয়া হাওয়া— ‘‘আমি এখনও বিশ্বাস করি কলকাতার সংস্কৃতি ধর্মনিরপেক্ষতার। যে ভাবেই হোক সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রুখতে হবে।’’

রাজাবাজারের মাংস বিক্রেতা কিংবা বেলগাছিয়ার শিক্ষকও একই হাওয়া টের পাচ্ছেন। কাপড়ের ব্যবসায়ী ইজাজ আহমেদের স্পষ্ট বক্তব্য, ‘‘লাল দল ভাল ছিল, না সবুজ দল, সে সব ভাবার অনেক সময় আছে। কিন্তু এ বারের ভোট বাঁচার লড়াই। মুল্‌ক বাঁচানোর লড়াই। এটা বুঝে গিয়েছেন সকলে।’’

মুসলিম মহল্লায় ভয় যে একটা কাজ করছে, প্রতিদিন টের পাচ্ছেন নাখোদা মসজিদের ইমাম মৌলানা মহম্মদ শফিক কাসমি। তবে তিনি বিশ্বাস করেন, কলকাতা শহরে মেরুকরণের রাজনীতি দাগ কাটতে পারবে না। তাঁর মতে, ‘‘দেশ যাঁরা ভাঙতে চান, মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি করতে চান, তাঁরা নানা রকম প্রচার করছেন। কিন্তু হিন্দুস্তানের সংস্কৃতি এ কাজ কোনও দিন করতে দেবে না। আর বাংলায় তো নয়-ই।’’

এক দিকে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল, অন্য দিকে নাগরিকপঞ্জি। ‘‘ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেবে তো আমাদের! অসমে তো তা-ই করছে!’’ দেওয়ালে পিঠ ঠেকালেন রফিক। স্কুলে পড়ান। খবরের কাগজে নাম বেরোবে শুনেই আতঙ্কে কুঁকড়ে গেলেন দৃশ্যত ‘আলু-ভাতে’ বাঙালি। ভোটার কার্ড, পাসপোর্ট সবই আছে তাঁর। তীব্র বিরোধী হয়েও বানিয়েছেন আধার কার্ড। তবু যবে থেকে অসমে আগুন, ঘুম ছুটেছে সাত দশক আগে অবিভক্ত বাংলার পূর্ব প্রান্ত থেকে পাকাপাকি এ পারে চলে আসা পরিবারের বর্তমান সদস্যের। ছোটবেলা কেটেছে দিনাজপুরে। কোনও যুক্তিতেই তাঁকে বোঝানো গেল না, এ রাজ্যে এনআরসি হলেও তাঁর সমস্যা হওয়ার কথা নয়। ‘‘নয় তো?’’ আকুল প্রশ্নে সত্যি সত্যিই যুক্তির বাঁধ ভাঙে। মনে পড়ে যায় গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য তপোধীর ভট্টাচার্যের কথা— ‘‘অসমের নাগরিকপঞ্জিতে যাঁদের নাম নেই, তাঁদের অনেকেরই নাম না থাকার কোনও যুক্তিও নেই।’’

বামপন্থী রফিকের সমস্যা অনেক। দিনাজপুর থেকে চাকরি সূত্রে কলকাতায় এসে ঘর খুঁজেছিলেন বন্ধুবরের হিন্দু পাড়ায়। এবং সেই প্রথম তাঁকে শুনতে হয়েছিল, তিনি ‘বাঙালি’ নন, ‘মুসলিম’। যাদবপুর, হরিদেবপুর কোথাও বাড়ি ভাড়া না পেয়ে তিনি প্রথমে বাসা ভাড়া নেন রাজাবাজারে। কিন্তু উর্দুভাষী মুসলিম মহল্লায় কোনও ভাবেই বাঙালি জীবন মানাতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত হগ মার্কেটের পিছনে নতুন বাড়ি পেয়েছেন। উল্লেখযোগ্য বদল একটাই— পাশের ঘরে বাংলা চ্যানেল চলে। ১০ বছরেও কলকাতাকে আপন মনে হয়নি রফিকের। তিনি মানেন, বাম, অবাম কোনও দলই বাঙালি, অবাঙালি মুসলিমদের মধ্যে তফাত করে না। রাজনীতির চোখে তাঁরা কেবলই ভোট ব্যাঙ্ক। কিন্তু এ বারের ভোটে এ সব কথা বলতে চাইছেন না রফিক— ‘‘আগে গেরুয়া যাক। নইলে অসমের আগুন এখানেও ঢুকবে।’’

কলকাতার বাঙালি মুসলিমদের সমস্যা নিয়ে বহু দিন ধরে সরব বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশন কলেজে বেদান্তের শিক্ষক শামিম আহমেদ। বাড়ি ভাড়া পেতে একদা তাঁকেও কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। সম্প্রতি ‘গেরুয়া সন্ত্রাসে’ ভুক্তভোগী শামিম স্পষ্ট বলছেন, ‘‘আগে বড় সমস্যার মোকাবিলা হোক, পরে অন্য কথা।’’

সংখ্যালঘু ভোট ভাগ হয়ে গেলে যে গেরুয়া শিবিরের লাভ হতে পারে, শামিমের মতোই মানছেন কলুটোলার আতর ব্যবসায়ী নিয়াজউদ্দিন আল্লা বকস। কলকাতায় কয়েকশো বছরের পুরনো তাঁদের ব্যবসা। প্রাচীন তাকের কোণায় কোণায় রঙিন রঙিন গন্ধ। নানা রঙের তরলের দিকে আঙুল তুলে নিয়াজউদ্দিন বলছিলেন, ‘‘ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছি, এটাই ভারতবর্ষ। নানা রঙের। এরা কি সব তছনছ করে দিতে চাইছে?’’ কারা? সাংবাদিকের প্রশ্নের পিঠোপিঠি উত্তরে একটি রাজনৈতিক দলের নাম বলেও প্রত্যাহার করলেন নিয়াজউদ্দিন। ‘‘দলের নাম লিখবেন না।’’ নীরবতা। ‘‘কী দরকার ঝামেলায় জড়িয়ে!’’

কোনও দলের নাম বলতে চাননি নাখোদা মসজিদের ইমাম সাহেবও। তবে একটি বার্তা দিতে চেয়েছেন— ‘‘যারা দেশকে টুকরো টুকরো করতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ান। ধর্ম নিরপেক্ষ ভারতের পক্ষে দাঁড়ানো জরুরি।’’

ইমাম-দফতরের বাইরে বিকেলের রোদ-ছাদ ততক্ষণে গ্রাস করছে মসজিদের বিপুল গম্বুজের ছায়া। দাঙ্গার ছায়া-সময়ে জাকারিয়া স্ট্রিটের শিবমন্দির আগলে রাখার গল্প শেষ করে ইমাম সাহেব আড্ডা ভাঙলেন শায়েরিতে— ‘লাগে গি আগ তো আয়েঙ্গে ঘর কয়-ই জদ মে/ ইঁহা পে সির্ফ হমারা মকান থোড়ি হ্যায়।’ অর্থাৎ আগুন লাগলে কারও ঘরই বাঁচবে না।

সন্ধের জাকারিয়া স্ট্রিট জ্বলে উঠল বিকিকিনির ঝলমলে আলোয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE