Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
general-election-2019-analysis

ব্রাত্য ভূখণ্ডের ভোট ধুঁকছে চরমেঘনায় 

ভিজে গামছায় পিঠ রগড়ে সেই তিরতিরে নদীর ও পাড় থেকে আবু হাসেম হাঁক পাড়েন, “কী কর্তা, নতুন মুখ যে, ভোট দ্যাখতি আসতিছেন নাকি!”

চরমেঘনার পথ। নিজস্ব চিত্র

চরমেঘনার পথ। নিজস্ব চিত্র

রাহুল রায়
চরমেঘনা শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৯ ০৪:১৯
Share: Save:

গত ক’দিনের বর্ষায় ছিপছিপে মাথাভাঙা নদী এক গলা জল নিয়ে তর তর করে বইছে। ও পারে সবুজ পাট খেতের আড়ালে মহিষকুণ্ডা গ্রাম। জেলা কুষ্ঠিয়া, বাংলাদেশ।

ভিজে গামছায় পিঠ রগড়ে সেই তিরতিরে নদীর ও পাড় থেকে আবু হাসেম হাঁক পাড়েন, “কী কর্তা, নতুন মুখ যে, ভোট দ্যাখতি আসতিছেন নাকি!”

ভারতের শেষ ভূখণ্ড, চরমেঘনার ঘাটে দাঁড়িয়ে, আমাদের ছুড়ে ছুড়ে সংলাপের মাঝে এ পাড়ের মাছরাঙা উড়ে যায় ও প্রান্তের জামরুল গাছে। কাঁটাতারের সীমানা ভেঙে ও দিকের কৌতূহল উড়ে আসে এ পাড়ে, “আপনাগো চরমেঘনার ভোটে এ বার কী হইবে কর্তা?”

আধা সেনার অনুশাসনে দিনযাপন করা চরমেঘনা জুড়ে এই ঘোর চৈত্র দুপুরে প্রশ্নটা মাথা কুটছে, কী হবে?

যাই হোক না, তা বলে ‘ওদের’ এমন কৌতূহল কেন? পড়শি দেশের এমন ঔৎসুক্যে বেজায় বিরক্ত চরমেঘনা। অন্তত এই প্রশ্নে, হাত-হাতি-হাতুড়ি-ঘুসফুল এমনকী পদ্মও কপালে ভাঁজ ফেলে বলছে— এত কিসের উৎসাহ হে!

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

এক ফালি নদীর ও পাড়ে প্রতিবেশী ‘দ্যাশের’ উপরে বেজায় উষ্মা সক্কলের। গায়ে গা লাগানো পড়শির এটুকু কৌতূহল থাকতে পারে না?

চরমেঘনার গ্রাম সংসদের বহুজন সমাজ পার্টির (বিএসপি) প্রাক্তন সদস্য সমর বিশ্বসারে কাছে প্রশ্নটা রাখতেই আঁচানো তেলে মাছ ছাড়ার মতো ছ্যাঁক করে উঠছেন, “ও পাড়ের মাইনষ্যের আমাগো ভোটের ফলাফল নিয়ে কামডা কি শুনি!” হাতি প্রতীকে জয়ের সুবাদে চরমেঘনা ‘আদর’ করে তাঁকে এক সময়ে নাম রেখেছিল ‘সমর হাতি’। তাতে অবশ্য আপত্তি নেই। ‘অপরাধ’ শুধু পড়শি মহিষকুন্ডার গ্রামীণ মানুষের কৌতূহলে।

ডোমকল-করিমপুর রাজ্য সড়ক থেকে সেই ‘বিদেশ’ সাকুল্যে তিন কিলোমিটার। মেঘনা বর্ডার আউটপোস্টে বিএসএফের একপ্রস্ত জেরার পরে কিলোমিটার দেড়েক হাঁটলে কাঁটাতারের সেই অমোঘ বেড়া। রাস্তাটা সদ্য পাকা হয়েছে। বৃষ্টির পরে দু’পাড়ের বনজ ঝোপ থেকে মাটির গন্ধ। শীর্ণ দুই বলদ নিয়ে মাঠে যাওয়ার পথে মেঘনা গ্রামের মহিতোষ মণ্ডল বলেন, “এই যে ন্যাশনাল কাঁটা দেখত্যাছেন, তার ওপারে চরমেঘনা। যাইতে হইলে বিএসএফের কাছে ভোটার কার্ড জমা রাখতি অইব।”

শুধু কার্ড নয়, বাপ-ঠাকুর্দার নাম, শাড়ির কোঁচড়, দু’ভাঁজ করা লুঙ্গির খুঁট— সর্বস্ব উজাড় করার পরে বিএসএফের জিম্মায় আরও এক গুচ্ছ শর্ত মেনে চলার প্রতিশ্রতি দিয়ে চরমেঘনায় প্রবেশের অনুমতি মেলে। বাংলাদেশের জমিতে নদিয়ার করিমপুর-১ ব্লকের হোগলবেড়িয়া পঞ্চায়েতের সেই এক ফালি চরের ঠিকানায় পা রাখতে গেলে আবহমান কাল ধরে এটাই নিয়ম।

চরের আনাচে কানাচে, বাঁশ ঝাড় থেকে বাড়ির উঠোন— ঘাস আর পদ্মফুলের আর্দ্র পতাকা পত পত করে উড়ছে। নিবিড় সহবস্থানে ভিজে পতাকা জড়িয়ে রয়েছে একে অপরকে। তৃণমূলের আবু তাহের কিংবা বিজেপি’র হুমায়ুন কবীর, দুই প্রার্থীও নিজেদের প্রচারের সুর বেঁধে রেখেছেন একই ঘনিষ্ঠ মাত্রায়— বিএসএফের অনুশাসন।

বারো কিলোমিটার দূরের সবেধন অথচ বেহাল শিকারপুর স্বাস্থ্যকেন্দ্র, পরিশুদ্ধ জলের আকাল, বাংলাদেশি দুষ্কৃতীর হানা আর সর্বোপরি সীমান্তরক্ষীদের অনুকম্পায় দিনযাপন, সক্কলের এক রা— এমন কঠোর অনুশাসনে মানুষগুলো যেন ব্রাত্য এক ভূখণ্ডের বাসিন্দা হয়ে ধুঁকছে।

বিএসএফের কমান্ড্যান্ট তাঁর কাঁচি-ছাঁটা গোঁফে সযত্নে হাত বুলিয়ে বলছেন, ‘‘কী করব বলুন, ও পাড়ের হানাদারি রুখতে কড়া তো হতেই হবে!’’

রাতের মাঝামাঝি তাই প্রসব যন্ত্রণা উঠলে, বিএসএফের নিয়মের গেরো ঠেলে শিকারপুর স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পথে অ্যাম্বুল্যান্সের চাকা গড়ানোর আগেই পা দাপিয়ে নিথর হয়ে গিয়েছে প্রসূতির দেহ— এমন ঘটনা চরমেঘনা নিশ্চুপে দেখে আসছে বছরের পর বছর। হেঁপো রোগীর শ্বাস কষ্ট উঠলে ওষুধের জন্য ভোরের অপেক্ষা, কলেজ পড়ুয়া ছেলের ঘরে ফিরতে বিকেল ফুরোলে ঝুপ করে বন্ধ হয়ে যাওয়া কাঁটাতারের ফটক— এমনই অগুন্তি অনুশাসনের আঁচে মন ভেঙে গিয়েছে চরমেঘনার। গ্রামের অনেকেই তাই সস্তায় দু-দেড় কাঠা জমি কিনে উঠে যাচ্ছেন শিকারপুর, করিমপুরের আশপাশে। ও পাড়ের আতঙ্ক আর এ পাড়ের অনুশাসনের মাঝে চুপ করে আছে চরমেঘনা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE