Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

জল দিতে পারে না দেশ, আর রুজি?

দশ টাকায় ২০ লিটারের জ্যারিকেন-ভর্তি জল। তাতেই খাওয়া, স্নান করা, বাসন মাজা, কাপড় কাচা।

জলের জন্য: লাইন রাখা বান্দাপানি চা বাগানে। ছবি: অস্মিতা শর্মা

জলের জন্য: লাইন রাখা বান্দাপানি চা বাগানে। ছবি: অস্মিতা শর্মা

গৌতম চক্রবর্তী
বীরপাড়া শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৯ ০৪:০৬
Share: Save:

ভারতবর্ষ ওঁদের পানীয় জল দিতে পারে না।

জলপাইগুড়ি জেলার বীরপাড়া থেকে আরও আধঘণ্টা গাড়িতে গেলে বান্দাপানি চা বাগান। আপাতত বন্ধ, শ্রমিকেরাই কমিটি তৈরি করে বাগান দেখাশোনা করেন। সেখানে এক জলকলের সামনে গাদা করে রাখা প্লাস্টিকের জ্যারিকেন। কলে জল নেই, মেয়েদের আরও দু’ কিলোমিটার পাহাড়ি পথে হেঁটে চলে যেতে হয় ভুটানের রেতি জঙ্গলে। আর এক বসতিতে শ্রমিকেরা চাঁদা তুলে ভুটান সরকারকে গত বছরেও জলের বিল বাবদ চার হাজার টাকা দিয়েছেন। পাশের লঙ্কাপাড়া চা বাগানেও ভুটানের ঝরনা এবং ছোট নদীনালা ভরসা। দশ টাকায় ২০ লিটারের জ্যারিকেন-ভর্তি জল। তাতেই খাওয়া, স্নান করা, বাসন মাজা, কাপড় কাচা। ‘‘থাকি এ দেশে, জল খাই ভুটানের,’’ বলছিলেন বান্দাপানির শ্রমিক ডমিনিক খালকো।

কথা বলতে বলতে পা চুলকাচ্ছিলেন ডমিনিক। আমার সঙ্গে ছিলেন মুম্বইযের ‘টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ’-এর অস্মিতা শর্মা। চা-বাগানের শ্রমিকদের নিয়ে গবেষণা করার জন্য অস্মিতা গত কয়েক মাস এই অঞ্চলেই রয়েছেন। তিনি জানালেন, ভুটানের জলে লাইমস্টোন থাকে। ফলে শ্রমিকেরা অনেকেই খুজলি, চুলকানি এবং পেটের রোগে ভোগেন। কারা যেন কথায় কথায় পাকিস্তানের সিন্ধু নদের জল বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেন! সম্ভবত নিজের দেশের এই সব মানুষের কথা তখন তাঁদের খেয়াল থাকে না।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

বন্ধ চা বাগানে কত যে সমস্যা! পরিচর্যার অভাবে চা গাছ বুনো ঝোপের মতো বেড়ে যায়, সেগুলি শ্রমিক-সমবায়কেই পরিষ্কার করে, কীটনাশক ছড়িয়ে যত্নআত্তি করতে হয়। সবুজ চা-পাতা এবার প্রসেসিং-এর জন্য যায় কারখানায়। অন্য বাগানের কারখানা অনেক সময় সরাসরি চা-পাতা কেনে, কিন্তু দাম বাকি রাখে। ডমিনিকরা তাই এজেন্টের কাছে বেচে দেন। এজেন্ট সঙ্গে সঙ্গে টাকা মিটিয়ে পাতা নিয়ে চলে যায়। বাগানে হাজিরা দিন প্রতি ১২০টাকা। মনরেগায় ১৭১ টাকা। কিন্তু ১০০ দিন নয়, গড়পরতা ৫০ দিনের কাজ মেলে।

অতএব, কুলিবস্তির সব ঘর থেকেই কেউ-না-কেউ কাজের খোঁজে বাইরে চলে গিয়েছে। ছেলেরা সিকিওরিটি গার্ড, হোটেল-রেস্তরাঁয় বেয়ারা। মেয়েরা কেউ কেউ পেটে বাচ্চা নিয়ে ফিরে আসে।

শিশুর জন্যও এখানে ঘরের বাইরে বিপদ ওত পেতে থাকে। পুজা ওঁরাও সন্ধ্যাবেলা ঘরের কাজ করছিলেন, বাচ্চা উঠোনে হেঁটে বেড়াচ্ছিল। চিতাবাঘ তুলে নিয়ে যায়। কুলিবস্তির পুম্মা মঙ্গর বলছিলেন, ‘‘মাঝে মাঝে হাতিও হামলা করে।’’

চা বাগানে শিশুদের ক্রেশ। ছবি: অস্মিতা শর্মা

আছে সরকারি প্রকল্প নামের শ্বেতহস্তীও। এমএসকে বা মাধ্যমিক শিক্ষা প্রকল্পের স্কুলগুলি দশম শ্রেণি অবধি থাকার কথা। অথচ এখানে বেশির ভাগই অষ্টম শ্রেণি অবধি। স্কুলে যেতে সাইকেল কাজে আসছে। কিন্তু বেশির ভাগ সাইকেলই পাঁচ মাসের বেশি টেকে না। ‘‘কলকাতা থেকে আসতে আসতে নিশ্চয় হাতবদল হয়, অনেক ধকল যায়,’’ হাসলেন চা-বাসা লাইনের সঙ্গীতা খাড়িয়া।

প্রসূতি মেয়েদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য নিখরচার অ্যাম্বুল্যান্স বা ‘নিশ্চয়যান’ আছে। পুম্মারা বললেন, ‘‘কিন্তু বেলা ১২টার পর ফোন করলে পাত্তা মেলে না। সন্ধ্যার দিকে ডাকলে ছয়-সাতশো টাকা দিতে হয়।’’ আইন অনুযায়ী, মা যখন বাগানে পাতা তুলতে যাবেন, বাচ্চা থাকবে ক্রেশে। সেই ক্রেশ দেখা গেল মেচপাড়া, চুয়াপাড়ার মতো হাতে-গোনা কয়েকটা বাগানে। শাড়ি দিয়ে তৈরি ঝোলায় বাচ্চা, পিছনে দুধের বোতল। মায়েরা এখানে বেশির ভাগই অপুষ্টির শিকার, জানালেন অঙ্কিতা।

এত কিছুর পর অসুস্থ শিশুকন্যাকে স্বামী, জা, ভাসুরের কাছে রেখে কাজের খোঁজে দিল্লি গিয়েছিল এখানকার জ্যোতি মঙ্গর। কিছু দিন পর আরও বেশি টাকার কাজের খোঁজে জ্যোতি চলে গেল কুয়েতে এক তৈল ব্যবসায়ী পরিবারে। তারা আদৌ ভিলেন নয়, জ্যোতির স্বামী কাঞ্ছাকে ফোন করেওছিল।

এ দিকে জ্যোতির মেয়ে আরও অসুস্থ। মালিক ও মালকিন তাকে ভারতে ফেরার টাকাও দেয়। কিন্তু কুয়েত পুলিশ জ্যোতিকে আটক করে। ভারতীয় পাসপোর্টে নয়, সে এ দেশে এসেছে নেপালের নকল পাসপোর্টে। জ্যোতি লেখাপড়া জানে না, সেই সুযোগে দিল্লির আড়কাঠিরা এই কাণ্ড ঘটিয়েছে। এখানকার লোকেরা এ নিয়ে নানা জায়গায় দরবার করেছেন। কিছু হয়নি।

পুনশ্চ: এই ঘটনার কয়েক দিন পরে জ্যোতির মেয়েটি মারা যায়। জ্যোতি এখনও দেশে ফিরতে পারেনি। বাড়ি বন্ধ। শুনলাম, তার স্বামী কাজের খোঁজে অরুণাচল প্রদেশে চলে গিয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE