Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
Lok Sabha Election 2018

কেউ হাঁটছেন, কেউ আনছেন অভিনব গাড়ি, তার মধ্যেই হাইজ্যাক স্লোগান, প্রচার জমজমাট বঙ্গে

‘এই তৃণমূল আর না’ গানটির বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনের দ্বারস্থ হয় তৃণমূল এবং বাবুল সুপ্রিয়কে শো-কজের মুখে পড়তে হয়।

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ মার্চ ২০১৯ ২২:২৮
Share: Save:

কৌশল, পাল্টা কৌশল, প্রতিপক্ষের অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা, প্রতিদ্বন্দ্বীর দুর্বলতা চিহ্নিত করে নিয়ে সেখানেই ঝাঁপিয়ে পড়া— বাংলায় জমজমাট চেহারা নিতে শুরু করল ভোটের প্রচার। সব দল মিলে পুরোদস্তুর প্রচারে নেমেছে সপ্তাহখানেক হল বড়জোর। কিন্তু এর মধ্যেই রাজনীতির মারপ্যাঁচে রঙিন হয়ে উঠতে শুরু করল রাজ্যের নানা প্রান্ত। সর্বাগ্রে প্রার্থী ঘোষণা করতে পেরে তৃণমূল অবশ্যই অন্যদের চেয়ে বেশি স্বস্তিতে। কিন্তু কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়েও কোথাও বিজেপি, কোথাও কংগ্রেস যে ভাবে সাজাতে শুরু করেছে প্রচারের ঘুঁটি, তাতে ভোটের বাজার সরগরম।

প্রচারের শুরুতেই চমক দেওয়ার চেষ্টায় ছিল বিজেপি, কিন্তু শুরুতেই জোর ধাক্কা। পুরুলিয়া থেকে দলীয় কর্মীকে ডেকে পাঠিয়ে গান লেখা, তার পরে মুম্বই গিয়ে সুর দেওয়া, রেকর্ড করা, সম্পাদনা ও যন্ত্রানুষঙ্গ দেখভাল করা— বাবুল সুপ্রিয়র এত পরিশ্রম বৃথা যেতে বসেছিল। ‘এই তৃণমূল আর না’ গানটির বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনের দ্বারস্থ হয় তৃণমূল এবং বাবুল সুপ্রিয়কে শো-কজের মুখে পড়তে হয়। কমিশনের অনুমতি না নিয়ে কী ভাবে গানটাকে বাজারে ছাড়ল বিজেপি? এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় গেরুয়া শিবিরকে।

বিজেপির তরফে অবশ্য আইনি আঁটঘাট বেঁধেই নির্বাচন কমিশনকে জবাবি চিঠি দেওয়া হয়েছে। কমিশন এখনও পর্যন্ত কোনও স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা জারি করেনি। বাবুলরাও যত্ন সহকারে গানটির স্মার্ট ভিডিয়ো তৈরি করিয়ে এনেছেন মুম্বই থেকে। সোশ্যাল মিডিয়ায় সে ভিডিয়ো শেয়ারও করে দিয়েছেন। কিন্তু বিতর্ক তথা শো-কজের জেরে যে ক’দিন থমকে গিয়েছিল বিজেপি, সে ক’দিনেই অস্ত্রটা বেশ খানিকটা হাইজ্যাক করে নিয়েছে তৃণমূল। বাবুলের গানে যে ভঙ্গিতে আক্রমণ করা হয়েছে তৃণমূলকে, ঠিক সেই ভঙ্গিতে এবং সেই ছন্দে পাল্টা স্লোগান বানিয়ে ফেলেছে তৃণমূল। মাত্র কয়েকটা দিনেই বাংলার প্রান্তে প্রান্তে ছড়িয়ে গিয়েছে ‘এই বিজেপি আর না’ স্লোগান। কোথাও তৃণমূল ছাত্র পরিষদ, কোথাও দলের যুব সংগঠন— একের পর এক মিছিলে স্লোগান উঠেছে— ‘বাড়ল তোমার গ্যাসের দাম, রক্ত চোষে বুড়ো ভাম, এই বিজেপি আর না’ অথবা ‘অচ্ছে দিনের এ কী মজা, চাকরি এখন পকোড়া ভাজা, এই বিজেপি আর না’।

বাবুল সুপ্রিয় অবশ্য দমে যাওয়ার পাত্র নন। পেশাদারি মুন্সিয়ানায় তৈরি করা থিম সং তথা ভিডিয়োটাকে দ্রুত জনপ্রিয় করতে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে জোর তৎপরতা দেখা গিয়েছে বাবুল শিবিরে। বিজেপি সূত্রের দাবি, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার মধ্যে ১০ লক্ষের আশেপাশে পৌঁছে গিয়েছে সে ভিডিয়োর ভিউয়ারের সংখ্যা। অতএব আসানসোলের বিজেপি প্রার্থী উচ্ছ্বসিত।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

তৎপরতা কিন্তু শুধু বাবুলের নয়, চমকে দেওয়া তৎপরতা দেখাচ্ছেন দমদমের বিজেপি প্রার্থী শমীক ভট্টাচার্যও। ২৪ মার্চ থেকে প্রচার শুরু করেছেন শমীক। বন্ধ জেসপের গেট থেকে সে দিন শুরু করেছিলেন পদযাত্রা তথা জনসংযোগ। সে দিন বোঝা যায়নি যে, পদযাত্রাই সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হয়ে উঠতে চলেছে বসিরহাট দক্ষিণের প্রাক্তন বিজেপি বিধায়কের। দিন পাঁচেকের মধ্যেই নিজের কেন্দ্রের সব ক’টা বিধানসভা এলাকা ছুঁয়ে ফেলেছেন শমীক। উত্তর দমদম, দমদম, রাজারহাট-গোপালপুর, বরাহনগর, পানিহাটি, কামারহাটি, খড়দহ— প্রত্যেকটা বিধানসভা এলাকায় কোনও না কোনও কর্মসূচিতে ইতিমধ্যেই অংশ নিয়েছেন তিনি। মূলত পদযাত্রা করছেন, হাঁটছেন সবচেয়ে জনবহুল রাস্তাগুলো ধরে। দোকানে-বাজারে হাত মেলাচ্ছেন, জনসংযোগ সেরে নিচ্ছেন বাস-অটোর যাত্রীদের সঙ্গেও।

পায়ে হেঁটে প্রচারেই বেশি ভরসা রাখছেন শমীক ভট্টাচার্য।

বিরাটিতে একটা জনসভা করেছেন শমীক। তাঁর হয়ে প্রচারে এসেছিলেন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব। তবে বড় সভা নয়, হাঁটতে হাঁটতে সর্বাধিক সংখ্যক ভোটদাতার কাছে পৌঁছনোই শমীকের স্ট্র্যাটেজি। বৃহস্পতিবার দমদম রোডে শমীক ভট্টাচার্যের পদযাত্রায় অংশ নেওয়া এক বিজেপি কর্মী বললেন, ‘‘এখানকার সাংসদ সৌগত রায় দেওয়াল দখলে এগিয়ে রয়েছেন। কিন্তু উনি হেঁটে হেঁটে মানুষের কাছাকাছি পৌঁছতে অভ্যস্ত নন। গাড়ি নিয়ে হয়তো ঘুরবেন আর সভা করবেন। তাই আমরা উল্টোটাতেই জোর দিচ্ছি।’’ রোজ কতটা হাঁটছেন শমীক? কর্মীরা বলছেন, গড়ে ৮-৯ কিলোমিটার। অর্থাৎ পাঁচ দিনে ৪০ কিলোমিটারের বেশি হেঁটে ফেলেছেন বঙ্গ বিজেপির বাগ্মী নেতা। এই নিবিড় জনসংযোগে ভর দিয়েই গন্তব্যের খুব কাছাকাছি পৌঁছে যেতে চাইছেন শমীক।

আরও পড়ুন: আরএসএস ঘনিষ্ঠ হওয়ার অভিযোগ, সরতে হল রাজ্যের বিশেষ পুলিশ পর্যবেক্ষককে

রোজ মাইলের পর মাইল হাঁটছেন আরও এক জন। দক্ষিণবঙ্গে নয়, গৌড়বঙ্গের পথে হাঁটছেন তিনি। ১৯৯৯ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রতিটা নির্বাচনে নিজের জয়ের ব্যবধান ক্রমশ বাড়িয়েছেন সেই সাংসদ। তিনি আর কেউ নন, বহরমপুরের সাংসদ তথা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অধীররঞ্জন চৌধুরী।

বহরমপুরে প্রচারে অধীররঞ্জন চৌধুরী।

অধীরের কাছে ভোটের সময়ে এই হাঁটাহাঁটি অবশ্য নতুন নয়। লোকসভা হোক বা বিধানসভা, যে কোনও নির্বাচনে হাঁটতে হাঁটতে গ্রাম-তস্য গ্রামে পৌঁছে যাওয়া আর ছোট ছোট পথসভা করা— এটাই অধীরের প্রচারের ধাঁচ। বড় জনসভায় ভোটারদের খুব কাছাকাছি পৌঁছনো যায় না বলেই অধীর মনে করেন। তাই এ বারও চিরাচরিত কৌশলেই শুরু করেছেন। আর সর্বাগ্রে হাঁটতে শুরু করেছেন সেই এলাকায়, যেখানে কংগ্রেস দুর্বল হয়ে গিয়েছে আগের চেয়ে— কান্দি, ভরতপুর, নওদা। অধীর অনুগামীদের কণ্ঠস্বর অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী শোনাচ্ছে বহরমপুর, বেলডাঙা, রেজিনগর এবং বড়ঞা বিধানসভা এলাকা নিয়ে। তাই ওই সব এলাকায় অধীরের পদযাত্রা ঢুকবে দুর্বল এলাকা মেরামত করার পরেই। অধীরের পদযাত্রার মাহাত্ম্য বোঝাতে গিয়ে অনুগামীরা মনে করাচ্ছেন, গঙ্গা-পদ্মার ভাঙন রুখতে মুর্শিদাবাদ জেলার এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত অধীরের সেই বিখ্যাত পদযাত্রার কথা। সেই যে সওয়ার হয়েছিলেন জনজোয়ারে, এখনও নামতে হয়নি নীচে।

আরও পড়ুন: রাহুল গাঁধীর হস্তক্ষেপে কংগ্রেসে লক্ষ্মণ শেঠ, প্রার্থী হচ্ছেন তমলুকেই

ভোটারদের দরজায় দরজায় পৌঁছে যাওয়ার যে জুড়ি নেই, তা রাজ্যের শাসক দলও সম্যক বোঝে। সবচেয়ে বেশি করে তার প্রমাণ মিলছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাড়ায়। দক্ষিণ কলকাতা আসনটাকে আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের খাসতালুক বলতে চান না অনেকে। গোটা লোকসভা কেন্দ্রটাই যেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজের পাড়া— তৃণমূলকর্মীরাই মনে করেন তেমনটা। সেই আসনে তৃণমূল যাঁকে প্রার্থী করেছে এ বার, সেই মালা রায় কলকাতা পুরসভার চেয়ারপার্সন তো বটেই। বছরভরের জনসংযোগ এবং সুমিষ্ট ব্যবহারের সুবাদে তিনি যথেষ্ট জনপ্রিয়ও। একে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাড়া, তাতে মালা রায়ের মতো প্রার্থী— বিন্দুমাত্র চিন্তিত হওয়ার কারণ থাকতে পারে না তৃণমূলের। তবু নিবিড় জনসংযোগ শুরু করে দিয়েছেন ৮৮ নম্বর ওয়ার্ডের দীর্ঘ দিনের কাউন্সিলর মালা। দলের তরফে গোটা তিনেক বড়সড় কর্মী সম্মেলন আয়োজিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। তার বাইরে মালা রোজ হাঁটছেন, বাজার-ঘাটে ঢুকে পড়ছেন, বড় রাস্তা ছেড়ে গলি-তস্য গলিতে পৌঁছে যাচ্ছেন, মোড়ের মাথায় বা মাঝরাস্তায় থেমে গিয়ে কারও সঙ্গে গল্প জুড়ে দিচ্ছেন, ভাল-মন্দের খোঁজ নিচ্ছেন, দেওয়াল লিখছেন। আর তাঁর সঙ্গে তৃণমূলের একেবারে সামনের সারির নেতা তথা রাজ্যের অত্যন্ত সিনিয়র মন্ত্রীদের কাউকে না কাউকে দেখা যাচ্ছে প্রায় রোজ। সব মিলিয়ে উৎসব উৎসব চেহারা দক্ষিণ কলকাতার তৃণমূল প্রার্থীর প্রচারে।

অরূপ বিশ্বাসকে পাশে নিয়ে প্রচারে ব্যস্ত মালা রায়। ছবি পিটিআই।

এত রঙের মাঝে আবার অভিনবত্বের প্রশ্নে নজর কাড়ছেন আসানসোলের সেই বাবুল। ভোটের বাজারে এক বিশেষ গাড়ি আমদানি করছেন তিনি। গাড়ি নির্মাতা সংস্থার সঙ্গে কথা বলে গাড়িটি তৈরি করিয়েছেন। দু’একদিনেই সে গাড়ি ছুটতে শুরু করবে আসানসোলের প্রান্তে প্রান্তে। কী রয়েছে গাড়িতে? বাবুল বললেন, ‘‘বিশেষ কিছু নয়, এমনিতে সাধারণ গাড়ি, এসি-ও নেই। কিন্তু গাড়িতে একটু বেশি আসনের ব্যবস্থা রয়েছে, আর রয়েছে পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেম। গাড়ি থেকেই সভায় ভাষণ দেওয়া যাবে, গাড়িটাকেই মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।’’

ভোট প্রচারের জন্য বাবুল সুপ্রিয়র বিশেষ গাড়ি।

গাড়ি থেকে ভাষণ দেওয়ার এই রেওয়াজটা বাংলায় খুব একটা নেই। তামিলনাড়ুতে জয়ললিতা বা করুণানিধিদের দেখা যেত গাড়ি থেকে ভাষণ দিতে। পঞ্জাবে প্রকাশ সিংহ বাদলকেও সেই পথ নিতে দেখা গিয়েছে কখনও কখনও। কিন্তু বাংলার নির্বাচনে হঠাৎ এই নতুন রং কেন আমদানি করতে হল? কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বললেন, ‘‘আমার কেন্দ্রে আমি যখন যা করতে যাই, তাতেই তো তৃণমূল বাধা দেয়। প্রচারেও বাধা দিচ্ছে। সভার অনুমতি দেবে না, মাইক বাঁধতে দেবে না, আলো লাগাতে দেবে না। তাই কর্মীদের বলে দিয়েছি, কোনও চিন্তা করার দরকার নেই। মাইক, আলো, জেনারেটর— কিচ্ছু জোগাড় করতে হবে না। শুধু জমায়েতটা করুন, তা হলেই হবে।’’

প্রচারে অভিনবত্ব আনার চেষ্টা করছেন বাবুল সুপ্রিয়।

কর্মীরা জমায়েতটা করলে বাকিটা কী ভাবে সামলে নেবেন বাবুল? তিনি জানালেন, এই গাড়িতেই সব ব্যবস্থা থাকছে। গাড়ির ছাদটাকেই মঞ্চ হিসেবে যাতে ব্যবহার করা যায়, সে রকম ব্যবস্থা করা হয়েছে। গাড়িতে মাইক তো রয়েইছে। তাই গাড়িটা এলাকায় পৌঁছে গেলেই সভার আয়োজন হয়ে যাবে।

বাবুলের প্রচারে বিশেষত্ব আরও একটা লক্ষ্যনীয় এ বার। তাঁর সঙ্গে থাকছে তাঁর পরিবারও। স্ত্রী-কন্যা তো বটেই, বাবুলের বাবা এবং মা-ও প্রচারে ছেলের সঙ্গী হতে উৎসাহী। বিদায়ী সাংসদের পরিজনদের সঙ্গে কথাবার্তা বলায় উৎসাহও দেখাচ্ছেন অনেকেই, খবর বিজেপি সূত্রের। একটু বেশি সিটের গাড়িকে বেছে নেওয়া সম্ভবত সে কথা মাথায় রেখেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE