Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
Lok Sabha Election 2019

অধিকারের খাসজমি, নাকি পদ্মপাতায় শিশির

মালদহে যেমন গনি খান চৌধুরীর খানদান, পূর্ব মেদিনীপুর জুড়ে তেমনই অধিকারীদের একচ্ছত্র অধিকার। তার কেন্দ্রে কাঁথির ‘শান্তিকুঞ্জ’— বাড়ির মালিকের নাম শিশির অধিকারী।

সোমেশ ভট্টাচার্য 
কাঁথি শেষ আপডেট: ১১ মে ২০১৯ ০১:৪৬
Share: Save:

ধানখেতে ঘেরা চিংড়ির ভেড়ির পাশে ফিনফিন করে উড়ছে একলা একটা পতাকা। জোড়াফুলের।

এখানে অধিকারীতন্ত্র চলে।

মালদহে যেমন গনি খান চৌধুরীর খানদান, পূর্ব মেদিনীপুর জুড়ে তেমনই অধিকারীদের একচ্ছত্র অধিকার। তার কেন্দ্রে কাঁথির ‘শান্তিকুঞ্জ’— বাড়ির মালিকের নাম শিশির অধিকারী। যাঁর অধিকারের বৃত্তটা কেবলই বেড়েছে। শহর ছাড়িয়ে রাজ্য, রাজ্য ছাড়িয়ে দিল্লি। পরে বাবার পথে এসে রাজপাট আরও বিছিয়ে বসেছেন তস্য পুত্র শুভেন্দু অধিকারী।

দীর্ঘদিনের বিধায়ক, টানা দু’বারের সাংসদ সেই শিশির অধিকারীই ফের প্রার্থী। একান্ত আলাপে বিরোধীরাও যাঁকে কার্যত ‘অপরাজেয়’ বলে মনে করেন। কিসের জোরে এই অজেয় ভোটব্যাঙ্ক? শিশিরবাবু বলছেন— ‘‘লোকে জানে, আমার দরজা সব সময়ে খোলা। আমার কাছে আসতে কারও স্লিপ লাগে না। এই বাড়ির ভোটও তাই কোথাও যায় না।’’

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

লোকে কিন্তু বলছে, দিঘার সমুদ্র ছুঁয়ে এ বার একটু এলোমেলো হাওয়া চলছে। রসুলপুর নদীর নোনা জলে ভাটার টান। উত্তর কাঁথির কালীনগর গ্রামের ভেড়িতে যে একলা পতাকা দাঁড়িয়ে, সে কিন্তু আসলে একলা নয়। ইতিউতি আরও দু’চারটে অন্য রকম ফুল চোখে পড়ছে বইকি। বিরোধীরা প্রচারে নিশানা করছে তৃণমূল প্রার্থীর আশি ছুঁইছুঁই বয়স আর অসুস্থতাকে।

হেসে ফেলে শিশিরবাবু বলছেন— ‘‘শুনুন, আমার ছেলেবেলায় অ্যাজ়মা ছিল। ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় সারিয়েছিলেন। বাবাকে বলেছিলেন, ওর এমন কঠিন সব রোগ হবে যে রটে যাবে, ও মারা যাচ্ছে। কিন্তু ও শ্মশান থেকে ফিরে আসবে!’’

চণ্ডীপুর, পটাশপুর, কাঁথি উত্তর ও দক্ষিণ, ভগবানপুর, খেজুরি, রামনগর— এই সাত বিধানসভা নিয়ে কাঁথি লোকসভা কেন্দ্র। গত লোকসভা ভোটে চণ্ডীপুর ছাড়া বাকি ছ’টিতেই ৩০ হাজারের বেশি লিড ছিল। প্রায় ৫৩ শতাংশ ভোট পান শিশিরবাবু। উল্টোপাল্টা হাওয়া তার কতটা উড়িয়ে নেবে? আদৌ কি হাওয়া এলোমেলো?

তালপাটি খালের কাছে চুপ করে আছে গ্রীষ্মের দুপুর। ও পারে ঝিরঝিরে পাতা ছাওয়া জমিনের নাম নন্দীগ্রাম। এ পারে খেজুরি— জননী ইটভাটা, পাশে তেখালি সেতু। ও পারের রাস্তা দিয়ে মোটরবাইকে যেতে যেতে থমকে দাঁড়িয়ে আরোহী ডেকে বলেন, “দাদা যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন, ওখান থেকেই হার্মাদেরা গুলি ছুড়ত এ দিকে। বারোটা বছর হয়ে গেল!’’

জননী ইটভাটার একটা চিমনি ঘুমিয়ে গিয়েছে বছর চারেক আগেই। আর একটার মুখে বিনবিন করছে সাদা ধোঁয়া। লুঙ্গিটা কষে বেঁধে মালিক নীলোৎপল মণ্ডল বলছেন, ‘‘২০০৭-এর ফেব্রুয়ারিতে হার্মাদেরা এসে যে ঘরগুলোয় আমাদের কর্মীরা থাকতেন, সেগুলোর দখল নিয়ে নিল। ভাটা ছাড়তে হল আমাদের। পরের শীতের আগে আর খুলতে পারিনি।’’

নন্দীগ্রাম পর্বে সিপিএমের দুর্গ সেই খেজুরি বহু দিন তাদের হাতছাড়া। সে দিনের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা হিমাংশু দাস কাঁথি শহরে বাসা নিয়েছেন। গোটা তল্লাট জুড়ে শুধুই ঘাসফুলের মাথা নাড়া। তা-ই কি? মালিকের সঙ্গে কর্মীরাও মাথা নেড়ে বলছেন, ‘‘এ বার চোরা হাওয়া। আর, খেজুরি তো যখন যে দিকে যায়, পুরো ঢলে পড়ে!’’

দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পরে কুঞ্জপুরে সিপিএমের পার্টি অফিস খুলেছে। সামনে গাছতলায় কমরেডদের নিয়ে বসে দলের প্রার্থী পরিতোষ পট্টনায়ক। ঝকঝকে যুবা, ডিওয়াইএফ-এর জেলা সম্পাদক। মোলায়েম হাসি-মাখা মুখে অ-সিপিএমোচিত বিনয়। রোদজল উপেক্ষা করে ছুটে বেড়াচ্ছেন। খুব নাকি সাড়াও পাচ্ছেন।

অথচ সামান্য দূরে বাঁশগোড়ায় চায়ের দোকানে বসে সিপিএমের এক সময়কার পঞ্চায়েত সদস্যই বলছেন, ‘‘উঁচুতলার কয়েক জন নেতা ছাড়া কেউ মাঠে নেই। পার্টি-দরদিরাও অন্য দিকে ভোট দেবে।’’ কোন দিকে? পাশে বসা এক ছোকরা চোখের ইশারায় দেখিয়ে দিচ্ছেন রাস্তার ও পারে লটকানো পদ্ম-পতাকা।

ডান হাতের চার আঙুলে ছ’টা পাথর, বাহুতে তাবিজ-কবচ, গলায় মোটা সোনার চেন— বিজেপি প্রার্থী দেবাশীষ সামন্তের দেখা মিলল চণ্ডীপুরের তস্য গ্রামে, ঈশ্বরপুর পঞ্চায়েত অফিসের কাছে। চারপাশে হইহই করছে গলায় গেরুয়া উত্তরীয়, মাথায় ফেট্টি বাঁধা যুবকের দল। মাঝে-মাঝেই কারণে-অকারণে ‘জয় শ্রীরাম’ হুঙ্কার উঠছে। প্রার্থী যে কাঁথির পরিচিত শল্য চিকিৎসক, তা আপাতত তাঁকে দেখে বোঝার উপায় নেই। গত বার দু’লক্ষ ৩০ হাজার ভোটে জেতা তৃণমূল প্রার্থীকে প্রায় তুড়ি মেরে উড়িয়ে তাঁর দাবি, ‘‘কী হতে যাচ্ছে, আপনাদের ধারণাই নেই। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ফল্গুধারা বইছে!’’

কাঁথি শহরে ঘুপচি বাড়ির দুটো তলা জুড়ে বিজেপির নির্বাচনী দফতর। যুদ্ধ চালনা করছেন যিনি, সেই কাঁথি জেলা সাংগঠনিক সভাপতি তপন মাইতিকেই প্রার্থী হিসেবে চেয়েছিলেন জেলার নেতারা। শিকে ছেঁড়েনি। ক্ষোভে প্রবীণ এক নেতা শিবসেনার হয়ে দাঁড়িয়েও গিয়েছেন। কথায় মৃদু হিন্দির মিশেল, মুখে আলগা হাসি ছড়িয়ে প্রাক্তন জওয়ান তপনের দাবি, ‘‘তৃণমূলের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ আর মোদীজির উন্নয়ন ভাবনা, দুই মিলিয়ে করিশমা হয়ে যেতে পারে!’’ গত লোকসভা নির্বাচনে তাঁদের সাড়ে ৮ শতাংশ ভোট যে গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে ১৮ শতাংশ ছাপিয়ে গিয়েছে, আর বামেরা যে প্রায় ৩৫ শতাংশ থেকে নেমেছে ১৮ শতাংশে, সেই হিসেবও মনে করিয়ে দিচ্ছেন তিনি।

ঘটনা হল, পঞ্চায়েত নির্বাচনে এই এলাকায় তৃণমূলের ভোট ৬০ শতাংশ ছাপিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কী ভাবে, তা বাতাসে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে। বিরোধীদের দাঁড়াতে না-দেওয়া, রাত নামলেই বাইক বাহিনীর দাপাদাপি, বুথ থেকে এজেন্ট বার করে দেওয়া— তৃণমূলের পুরনো নেতাদেরও অনেকে এতটা বাড়াবাড়ি মানতে পারেননি। আমজনতার অবস্থা সহজেই অনুমেয়।

ধান, পান, মাছ, কাজুর এই তল্লাটে আরও কিছু আক্ষেপ-অনুযোগ আছে। ছোট চিংড়ি চাষিরা দর না পেয়ে বসে যাচ্ছেন। মাছের খোঁজে সমুদ্রে ট্রলার ভাসান যাঁরা, তাঁরা ডিজেলে ভর্তুকি পাচ্ছেন না। কিন্তু বড় মাছ আর কাজু কারবারি, কিছু খুচরো ব্যবসায়ী বাদে জিএসটি নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। নোটবন্দির দুঃস্বপ্ন মনে আছে প্রায় সকলেরই, যদিও অনেকেই আর তা আঁকড়ে বসে নেই।

তা বলে কি ‘মোদী হাওয়া’ চলছে? আদৌ নয়। হিন্দুত্ব ইস্যুও তেমন নেই। প্রায় কেউই অস্বীকার করছেন না যে ‘দিদি’ কাজ করেছেন। ‘বুড়া’ সাংসদের নামে গালমন্দ করার লোকও বেশি নেই। কিন্তু যা আছে, তা হল তৃণমূলের মেজোবাবুদের দুর্নীতি আর দাদাগিরি নিয়ে ক্ষোভ। আঙুল ফুলে কলাগাছ হতে দেখার ক্ষোভ। শিক্ষায় অগ্রণী এই জেলায় যথাস্থানে প্রণামী দিতে না-পারায় বেকার থাকার ক্ষোভ। তারই কাঁপুনি টের পাচ্ছে ভূপতিনগর থেকে পটাশপুর, বাজকুল থেকে রামনগর।

তৃণমূলের উপরে খেপে মানুষ যাবে কোথায়? কংগ্রেস প্রার্থী দীপক দাস নিজেই বলছেন, তাঁর ভোটে দাঁড়ানো শুধু সংগঠন বাঁচিয়ে রাখতে। ফলে প্রশ্ন এখন একটাই— বামেরা নিজেদের ভোট কতটা ধরে রাখতে পারবে, আর কতটা বিজেপির দিকে সরে যাবে? প্রায় ১৩ শতাংশ মুসলিম ভোটের কিছু হয়তো সিপিএমের কাছে ফিরে আসতে পারে। বাকিটা?

ভগবানপুরের বেঁউদিয়া মোড়ে দাঁড়িয়ে খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসছেন ভ্যানচালক কংগ্রেস মল্লিক— ‘‘আরে, সিপিএমের তো ভোট গুনতিই হবে না!’’ তবে কাঁথিতে পার্টি অফিসে বসে এই কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত হিমাংশু দাস, প্রাক্তন মন্ত্রী চক্রধর মেইকাপ, বেশ কিছু দিন তৃণমূলের ঘর করে ফেরা মাহমুদ হোসেনরা গলা চড়িয়ে বলছেন, ‘‘আমরাই লড়াইয়ে আছি। বিজেপি তো বহু বুথে এজেন্টই দিতে পারবে না।’’ ভোট বৈতরণী পার হতে নিজের পালে হাওয়া যেমন লাগে, ভোট ‘করাতে’ও যে জানতে হয়!

দক্ষিণ কাঁথির কাজুগ্রাম মাজনায় মির্জা রুকুনউদ্দিন বেগের কারখানায় গোল হয়ে ভাঙা কাজু বাছছিলেন জনা পাঁচ-ছয় মধ্যবয়সিনী। ভোট আসছে বলে ভারী খুশি, ভোট তাঁদের উৎসব। দিঘার সমুদ্দুরে নাকি পদ্ম ফুটবে? প্রথমে চোখ চাওয়া-চাওয়ি, তার পর হেসে গড়িয়ে পড়ে ওঁরা বলছেন— ‘‘না গো, পদ্ম নয়, পদ্মের কুঁড়ি!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE