Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

‘দেখুন না’, বাক্যবন্ধটা কি নাটকীয় পূর্বাভাস

বালুরঘাট থেকে সাতাশ কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের অনুশাসন তেমন নেই। আছে এক ফালি রেলপথ, দু’টো দেশকে টুকরো করে সেই লাইনের দু’ধারে এ-ওর ছায়া নিয়ে পড়ে আছে ছোট্ট জনপদ, হিলি।

—প্রতীকী ছবি

—প্রতীকী ছবি

রাহুল রায় 
বালুরঘাট শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৯ ০৪:৩১
Share: Save:

দু’টো পাড়াকে আড়াআড়ি ফুঁড়ে টানটান রেললাইন। ও পাড়ার ঝগড়া উড়ে আসে এ পাড়ে। দক্ষিণপাড়ার বটতলা থেকে উড়ে যায় টিপ্পনী— ‘বৌদির মুখে কী ঝাল গো!’ দু’পাড়ার আটপৌরে দিন গুজরানের মাঝে কাটাকুটি খেলে ঢাকার পথে ছুটে যায় নীলফামারি এক্সপ্রেস। লাইনের কোলে ঝুঁকে পড়া বেঁটে খেজুর গাছে এ ওকে ছুঁয়ে পতপত করে ওড়ে তিনটি খুদে পতাকা— লাল, গেরুয়া, সবুজ। আড়াআড়ি তার ছায়া পড়ে লাইনের ও-পারে ঢালু মাঠে।

বালুরঘাট থেকে সাতাশ কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের অনুশাসন তেমন নেই। আছে এক ফালি রেলপথ, দু’টো দেশকে টুকরো করে সেই লাইনের দু’ধারে এ-ওর ছায়া নিয়ে পড়ে আছে ছোট্ট জনপদ, হিলি। হিলি দক্ষিণপাড়ার সেই বটতলায় তাসের আড্ডা। হাতের গোলাম সপাটে ফেলে আদ্যন্ত বেকার অশোক ভৌমিক বিড়বিড় করেন, ‘‘কেউ কথা রাখে না, সব সমান। দেখছেন না, পতাকাগুলো, একে অন্যের ঘাড়ে দিব্যি কেমন আছে। কোনও বিরোধ নেই তফাতও নেই!’’

তফাতটা চোখে পড়ছে হিলি স্টেশন রোডে তৃণমূল কার্যালয়ের লম্বাটে বারান্দায়। এক ঝাঁক মেজ-সেজ নেতার ভিড়। খান সাতেক টোটোয় দলীয় পতাকা লাগাচ্ছেন এক ঝাঁক কর্মী। রোড-শো শুরুর প্রস্তুতিতে ‘হ্যালো মাইক টেস্টিং’এর ব্যস্ততা থামিয়ে স্থানীয় নেতা জানাচ্ছেন, ‘‘লিখে রাখুন, হিলি থেকে হাজার বিশেক লিড পাবেন ম্যাডাম!’’

‘ম্যাডাম’, বালুরঘাটের তৃণমূলের বিদায়ী সাংসদ অর্পিতা ঘোষের জেলা জুড়ে এটাই এখন সাবেক পরিচিতি, টের পাওয়া যাচ্ছে হিলির বিজেপি দফতরে পা রাখলেও। নিঝুম দরজায় কড়া নাড়তে স্থানীয় কর্মী বেরিয়ে জানালেন, সকলেই ভোটের কাজে বাইরে। সঙ্গে সংযোজন, ‘‘ম্যাডামের দলের মতো তো নয়, পার্টি অফিসে বইস্যা থাইকল্যে হবে? আমাগো মাস্টারমশাই পথে-প্রচারে ঘুইরা বেড়ান।’’ ‘তফাত’ ও ‘বিরোধের’ স্পষ্ট উপস্থিতির সঙ্গেই যুযুধান দু’পক্ষের মধ্যে একটা হাল্কা মিলও কান এড়াচ্ছে না— ‘মাস্টারমশাই’। ম্যাডামের মতোই বালুরঘাট লোকসভা কেন্দ্রের, আদ্যন্ত সঙ্ঘ পরিবার ঘনিষ্ঠ বিজেপি প্রার্থী সুকান্ত মজুমদারের এই ঘরোয়া পরিচয়টা ছড়িয়েছেন দলীয় কর্মীরা।

কুমারগঞ্জের বিজেপি অঞ্চল সভাপতি সুবীর সাহা আয়েশ করে চেয়ারে নিজের শরীরটা ছেড়ে দিয়ে তাই বলছেন, ‘‘আমাদের মাস্টারমশাই তো শুধু ভোট প্রার্থী নন, তিনি মানুষকে সচেতনও করছেন।’’

সেই সচেতনতার আঁচ কিছুটা মালুম হচ্ছে বালুরঘাটের কর্দমাক্ত বাস স্ট্যান্ডে। মালদহ-বালুরঘাট রুটের হেল্পার প্রণব পাল বাস স্ট্যান্ডের খাটো পাঁচিলে হেলান দিয়ে বলছেন, ‘‘বাড়ির সবাইকে বলে দিয়েছি, একশো দিনের কাজে যোগ দিবেন না। বাংলাদেশ থেকে এসে এখানে মাতব্বরি করবে ওরা, আর এ দেশে বাস করে তাদের খিদমত খাটব আমরা, চলবে না।’’

অভিযোগের লম্বা ফিরিস্তি দিয়ে ছেলেটি জানাচ্ছে— বালুরঘাট শহরটা এখন ও-পারের মানুষের কব্জায়। বলছেন, ‘‘আমরাই এখানে সংখ্যালঘু!’’ বালুরঘাটের মাস্টরমশাইও

কুশমন্ডির বাজারে দাঁড়িয়ে প্রচারের সিংহভাগ জুড়ে ইনিয়ে বিনিয়ে ‘অনুপ্রবেশের’ এই অস্ত্রেই ফালাফালা করছেন তৃণমূলকে। ছোট্ট মঞ্চ থেকে নেমে এসে পাঞ্জাবির হাতায় মুখ মুছে বলছেন, ‘‘উদ্বাস্তুর ভিড়ে বালুরঘাট প্রায় বিক্রি হতে চলল। এ বার সেই জবাবটাই ফিরিয়ে দেবে মানুষ।’’

শুনে মুচকি হাসছেন ম্যাডাম। সাত সকালে বেরিয়ে গাঁ-গঞ্জ, নদী-কাদা মাড়িয়ে বালুরঘাটের কংগ্রেস পাড়ায় তাঁর ছোট্ট ফ্ল্যাটে ফিরে ধ্বস্ত পা থেকে স্নিকার খুলে গ্রুপ থিয়েটারের পরিচিত মুখ অর্পিতা বলছেন, ‘‘ফোস্কা পড়ে গেল গো, এর পরেও বলবে ঘরে বসে ভোট চাইছি! মানুষ সব বোঝে। দেখবেন, এ বারও লিড থাকবে গত বারের কাছাকাছি। ছাপিয়েই যেত, যদি না...’’ খেইটা ধরিয়ে দিচ্ছেন সুকান্ত, ‘‘মনে রাখবেন, তৃণমূল প্রার্থীকে হারাতে বিশেষ খাটতে হবে না, দলের নেতারাই ওঁকে হারিয়ে দেবেন!’’

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

দলের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা সভাপতি বিপ্লব মিত্রের সঙ্গে অর্পিতার ‘মধুর’ সম্পর্কটা, মাস দেড়েক আগেও ছিল বালুরঘাটের চায়ের আড্ডার মুচমুচে বিষয়। দলনেত্রীর কড়া নির্দেশে সে ‘দূরত্ব’ মুছে গিয়েছে বলে বিপ্লব নিজেও দাবি করছেন বটে। তা হলে ম্যাডামের গত বারের লিড (১.৭ লক্ষ) ফিরে আসছে তো? গঙ্গারামপুরে তাঁর অফিস ঘরে বসে বিশেষ ভাঙছেন না বিপ্লব, ‘‘দেখুন না!’’

নিস্তেজ মুখে, ছোট্ট এই বাক্যবন্ধটা উচ্চারণ করছেন আরও এক জন, রণেন বর্মন, বালুরঘাটের আরএসপি প্রার্থী। সর্বমঙ্গলা সীমান্ত ছুঁয়ে, শেষ বিকেলে আলপথ ধরে পিলপিল করে হেঁটে চলা লাল ঝান্ডার লম্বা মিছিলের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে একদা বালুরঘাটের চার বারের নির্বাচিত সাংসদ বলছেন, ‘‘দেখুন না!’’

দেখছি, ‘মাস্টারমশাই’ আর ‘ম্যাডাম’-এর মাঝে কাটাকুটি খেলে সীমান্তের নিশ্চুপ রেলপথ ধরে উল্টো মুখে ছুটছে নীলফামারি এক্সপ্রস।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE