ভূপতিত: এ বছর সেপ্টেম্বরে জন্মের দ্বিশতবর্ষ পূর্তি হবে বিদ্যাসাগরের। তার আগেই ফের আক্রান্ত তিনি। মঙ্গলবার বিদ্যাসাগর কলেজে। নিজস্ব চিত্র
ভোটের তাণ্ডবে দ্বিশতবর্ষে ভাঙা হল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মূর্তি। বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের রোড শো থেকেই তাণ্ডব চালানোর অভিযোগ উঠল বিদ্যাসাগর কলেজে। শুধু দরজা, জিনিসপত্র ভাঙচুর নয়, অফিসঘরে বসানো বিদ্যাসাগর-মূর্তিও বিজেপি-সমর্থকেরা আছাড় মেরে ভেঙে দেন বলে অভিযোগ। বিজেপির পাল্টা অভিযোগ, শাহের রোড শোয়ে ইট ছুড়ে আক্রমণ চালিয়ে প্রথমে গোলমাল বাধিয়েছে তৃণমূলই। এমনকি রোড শো শুরুর আগেই পোস্টার-ফেস্টুন খুলে দিয়ে প্ররোচনা সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়েছিল শাসক দল।
মহামনীষীর মূর্তি ভাঙার নিন্দায় সরব হয়েছে বিভিন্ন মহল। উচ্চ পর্যায়ের আধিকারিকদের দিয়ে পুরো ঘটনার তদন্ত হবে বলে জানান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পুলিশ কমিশনার রাজেশ কুমার রাতে জানান, তদন্ত শুরু হয়ে গিয়েছে।
রাতে মুখ্যমন্ত্রী ঘটনাস্থলে যান। যান শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং পুলিশ কমিশনার। প্রশাসনের খবর, নির্বাচনী প্রচারের ফাঁকে মূর্তি ভাঙার খবর পান মমতা। তিনি কলকাতার পুলিশ কমিশনারকে ফোন করে কঠোর নির্দেশ দেন, ‘‘আইনশৃঙ্খলা রাজ্যের বিষয়। বিজেপির কিছু লোক এই কাণ্ড ঘটিয়েছে। যে-কোনও মূল্যে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করতে হবে।’’ পুলিশ রাতে জানায়, ১৬ জন হাঙ্গামাকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা হয়েছে। আগুন জ্বালানো হয়েছে। এটা ওঁর ২০০ বছর। কোনও রাজনৈতিক দলের এ-রকম হাঙ্গামা কখনও দেখিনি। বিহার-রাজস্থান থেকে গুন্ডা এনে এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে। নিন্দার ভাষা নেই। আমি লজ্জিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী। বাংলার মানুষ হয়ে আমরা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে সম্মান দিতে পারি না বিজেপির গুন্ডাদের জন্য।’’
কলকাতায় রোড শোয়ে অমিত শাহ। নিজস্ব চিত্র
মুখ্যমন্ত্রী জানান, আজ, বুধবার তাঁর মিছিল আছে। সকলকে শান্তিপূর্ণ ভাবে মিছিলে যোগ দিতে বলেন তিনি। মমতা বলেন, ‘‘অনেকে বলছে, পুলিশের তরফে নাকি বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। সেখানে গোটা ঘটনায় তৃণমূলের উপরে দায় চাপানো হয়েছে। কিন্তু আমি সিপি-র সঙ্গে কথা বলেছি। এমন কোনও বিবৃতি দেওয়াই হয়নি। পুরোটাই ভুয়ো।’’ তাঁর মন্তব্য, ‘‘তৃণমূল এ-সব করে না। এত বছর ধরে মিছিল করেছি। আমাদের ছাত্রেরা মিছিল করেছে। কোনও দিন এমন ঘটনা ঘটেনি।’’ মুখ্যমন্ত্রী কলেজে ঢুকে বিদ্যাসাগরের মূর্তির ভাঙা অংশগুলি কুড়িয়ে একটি বাক্সে রাখেন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসেও যান তিনি।
মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ বিধান সরণি দিয়ে শাহের রোড শো চলছিল। অভিযোগ, আচমকা এক দল সমর্থক পাঁচিল টপকে বিদ্যাসাগর কলেজের বিধান সরণি ক্যাম্পাসে ঢুকে হাঙ্গামা শুরু করেন। একটি মোটরসাইকেল ও একটি সাইকেলে আগুন ধরানো হয়। ওই কলেজের তৃণমূল ছাত্র পরিষদ (টিএমসিপি) নেতা অভিষেক মিশ্রের অভিযোগ, ‘‘আমরা কিছু করিনি। ক্যাম্পাসের ভিতরে ‘মোদী গো ব্যাক’ লেখা পোস্টার নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ওরা পাঁচিল টপকে ঢুকে ইট ছুড়তে শুরু করে।’’ অভিষেকের কান ফেটে রক্ত ঝরতে থাকে। অভিযোগ, বিজেপি-সমর্থকদের হাতে নিগৃহীত হন তিনি। ‘‘বিজেপির মিছিল থেকেই হাঙ্গামা হয়েছে। বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙেছে ওরা। পুলিশে অভিযোগ দায়ের করছি,’’ বলেন বিদ্যাসাগর কলেজের অধ্যক্ষ গৌতম কুণ্ডু। কলেজ পরিচালন সমিতির সদস্য দেবাশিস কর্মকার জানান, অফিসে রাখা তাঁর ল্যাপটপও ভাঙা হয়েছে।
সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা নাগাদ গোলমাল শুরু হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাস থেকে। শাহকে কালো পতাকা দেখানোর জন্য গেটের বাইরে জড়ো হয়েছিলেন টিএমসিপি-সমর্থকেরা। গোলমাল এড়াতে বিজেপির প্রচারের ব্যানার দিয়ে আড়াল করার চেষ্টা করেছিল পুলিশ। অভিযোগ, ক্যাম্পাসের ভিতর থেকে মিছিল লক্ষ্য করে জলের বোতল, আইসক্রিমের কাপ ছোড়া হয়। তার পরেই বিজেপি-সমর্থকেরা মারমুখী হয়ে ওঠেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের সামনে ব্যারিকেড উল্টে দেন তাঁরা।
রণক্ষেত্র: অমিত শাহের রোড শোয়ে তাণ্ডব। মঙ্গলবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে। ছবি: সুমন বল্লভ
রণক্ষেত্রের চেহারা নেয় গোটা এলাকা। টিএমসিপি-সমর্থকদের আড়াল করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে ঢুকিয়ে দেয় পুলিশ। বিজেপি-সমর্থকেরা গালিগালাজ করতে করতে ইট ছুড়তে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএমসিপি নেতা মণিশঙ্কর মজুমদারের দাবি, ‘‘ওরা ইট, পেরেক লাগানো লাঠি দিয়ে হামলা করেছে। আমাদের অনেকে আহত হয়েছে।’’ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে এই হামলা ও পড়ুয়াদের আহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে ফোন করা হলেও উপাচার্য সোনালি চক্রবর্তী বন্দ্যোপাধ্যায় সাড়া দেননি। উত্তর দেননি মেসেজেরও। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক পার্থিব বসু গোটা ঘটনার নিন্দা করেছেন।
কতটা নীচে নামলে তবে...
দু’শো বছরে শ্রদ্ধার্ঘ্য!
“কথা বলবার কোনও ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। অধঃপতনের আর কোন স্তর পর্যন্ত দেখতে হবে, জানি না।” —শঙ্খ ঘোষ
“বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা খুবই লজ্জাজনক ঘটনা। কলেজে ভাঙচুরও হয়েছে দেখলাম। এটা কী ধরনের ব্যাপার হল? কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। যে-ই ভেঙে থাকুক, তা আমাদের জন্য অত্যন্ত মর্মান্তিক একটি বিষয়।না।” —শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
“বিদ্যাসাগর মেয়েদের জন্য যা করেছেন, তার জন্য প্রতিদিন সকালে উঠে তাঁকে স্মরণ করা উচিত। তাঁর মূর্তি ভাঙা হল! তবে আমি মনে করি, এতে বিদ্যাসাগরের কিছু যায় আসে না। এ ভাবে মনীষীদের সম্মানহানি করা যায় না।” —কৃষ্ণা বসু
শাহ এবং অন্য বিজেপি নেতা যে-গাড়িতে ছিলেন, কলেজ স্ট্রিটের গোলমালের পরেই সেটি দ্রুত এগিয়ে যায়। ঠনঠনিয়া থেকে ফের মিছিল শুরু হয় ধীর লয়ে। কিছু দূর যেতে না-যেতেই ফের হাঙ্গামা বাধে। প্রত্যক্ষদর্শীদের একাংশ জানাচ্ছেন, বিদ্যাসাগর কলেজের বিধান সরণি ক্যাম্পাসের ভিতর থেকে মিছিলের উপরে কয়েকটি ইট উড়ে আসে। শাহকে ‘গো ব্যাক স্লোগান’ লেখা কালো পতাকা দেখানো হয়। স্লোগান চলতে থাকে। শাহের গাড়ি অবশ্য তার আগেই ওই তল্লাট ছেড়ে এগিয়ে গিয়েছিল। পুলিশ পরে সেই গাড়ি আটকায় এবং বলে, ‘‘আর এগোনোর অনুমতি নেই।’’ যদিও বিজেপির দাবি, বিবেকানন্দের জন্মভিটে পর্যন্ত রোড শোয়ের অনুমতি ছিল। সেই সময় শাহকে কলকাতা (উত্তর) কেন্দ্রের প্রার্থী রাহুল সিংহের উদ্দেশে কড়া চোখে কিছু বলতে দেখা যায়।
বিধান সরণি রণক্ষেত্রের চেহারা নেওয়ার পরে দোকানদারেরা ঝাঁপ ফেলে পালান। বড় পুলিশবাহিনী এসে অনেক ক্ষণ পরে পরিস্থিতি সামলায়। পরে দেখা যায়, কলেজ-চত্বরে বিদ্যাসাগরের ভাঙা মূর্তি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। অফিসঘরের কাচ, দরজা, আসবাব ভাঙা। ভিতরটাও লন্ডভন্ড। টিএমসিপি-র সমর্থক-পড়ুয়া স্বর্ণালী মিশ্র বলেন, ‘‘আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম। হামলাকারীদের দেখে পালিয়ে যাই।’’ গোলমালের পরে পুলিশ পোড়া মোটরবাইক সরাতে গেলে বিক্ষোভ শুরু করে টিএমসিপি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy