Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

তৃণমূলের সাজানো বাগানে পদ্মের গন্ধ

কংগ্রেসের মতোও দশা না হলেও, বোলপুরে সিপিএম কার্যত ধুঁকছে। একদা বীরভূমের লালমাটিতে লাল ঝান্ডা ছিল অপ্রতিরোধ্য।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

অনির্বাণ দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৯ ০৩:৫৩
Share: Save:

দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে জাতীয় রাজনীতির অলিন্দে ছিল প্রণব মুখোপাধ্যায়ের দাপুটে বিচরণ। কীর্ণাহারের এই ব্রাহ্মণ রাজনৈতিক জীবনে ছিলেন আদ্যন্ত কংগ্রেসি। কীর্ণাহার এবং প্রণব মুখোপাধ্যায় সমার্থক। সেই কীর্ণাহারে তাঁর প্রাক্তন দলের অবস্থা কার্যত কোমায় থাকা রোগীর মতো।

প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির এই গ্রাম বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত। ভোটগ্রহণ আগামী ২৯ এপ্রিল। ভোটগ্রহণের আগের রবিবার অর্থাৎ ২১ এপ্রিল কীর্ণাহার বাজারে প্রচার করছিলেন কংগ্রেস প্রার্থী অভিজিৎ সাহা। হাতে গোনা কয়েক জন কর্মী। সঙ্গে ব্যান্ড পার্টি নিয়ে বড় রাস্তা দিয়ে মিছিল করলেন ‘হাত’ চিহ্নের প্রার্থী।

কংগ্রেসের মতোও দশা না হলেও, বোলপুরে সিপিএম কার্যত ধুঁকছে। একদা বীরভূমের লালমাটিতে লাল ঝান্ডা ছিল অপ্রতিরোধ্য। শরদীশ রায়, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মতো সিপিএমের ডাকসাইটে নেতারা বোলপুরের সাংসদ ছিলেন। কিন্তু এখন বোলপুরে লাল ঝান্ডা কার্যত শক্তিহীন। ধরমপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের নৃপতি গ্রামে দেখা পাওয়া গেল সিপিএম প্রার্থী রামচন্দ্র ডোমের। কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে প্রচার করছিলেন তিনি। তাঁর অভিযোগগুলির মধ্যে অন্যতম হল, গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিচ্ছে তৃণমূল। ভোটের দিন দলের কর্মী-সমর্থকদের বুথ পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারবেন? প্রশ্ন শুনে থমকালেন সিপিএম প্রার্থী। বললেন, ‘‘ওদের সাহস জোগাচ্ছি। পাশে থাকছি।’’ যা অনুচ্চারিত রইল, তা হল, বাম ভোটারদের বুথ পর্যন্ত যাওয়া নিশ্চিত করার শক্তি তাঁদের নেই।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

প্রকৃতি কখনও শূন্যস্থান রাখে না। কংগ্রেস এবং সিপিএমের শক্তিক্ষয়ে বিরোধী পরিসরে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, সেই জায়গা দখল করতে শুরু করেছে বিজেপি। বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরলে পদ্মের সৌরভ যথেষ্টই অনুভূত হয়। যদিও বোলপুর জুড়ে জোড়াফুলের একচেটিয়া আধিপত্য। ত্রিস্তর পঞ্চায়েতে শুধুই তৃণমূল। কার্যত বিরোধী শূন্য। বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রের সাতটি বিধানসভা আসনের ছ’টিতেই জোড়াফুলের বিধায়ক। তাই বোলপুর যেন তৃণমূলের সাজানো বাগান। সেখানে কাঁটা বলতে ওই পদ্মফুল। সেই কাঁটায় শাসকের কতটা রক্তক্ষরণ হবে, আদৌ হবে কি?

বৈশাখের দুপুরে কীর্ণাহারে প্রচারে ব্যস্ত তৃণমূলের প্রার্থী অসিত মালের সঙ্গে দেখা। মুহুর্মুহু স্লোগান তুলছেন দলের কর্মী-সমর্থকেরা। এক গাল হেসে অসিত বললেন, ‘‘জয় সুনিশ্চিত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়নের ঝড় এবং অনুব্রত মণ্ডলের শক্তিশালী সংগঠনের দাপটে বিরোধীরা উধাও।’’ প্রার্থীকে নিয়ে তৃণমূলের জমাট ভিড়টা এগোতে থাকল। পাশের মাঠে একটি গাছের নীচে বসে এক দল যুবক। তাঁদের বয়স তিরিশের মধ্যেই। তৃণমূল প্রার্থীর এগোতে থাকা মিছিলের দিকে তাকিয়ে এক জন বললেন, ‘‘ভোট এ বার বড় ফুলেই। জোড়াফুলের দিন শেষ।’’ শুধু কীর্ণাহার নয়, গোপীনাথপুর, বন্দর, গোপাডিহি, কাড্ডার মতো এলাকাগুলিতে অল্পবয়সিদের মধ্যে নরেন্দ্র মোদীর জনপ্রিয়তা চোখে পড়ার মতো। বোলপুরে বিশ্বভারতীর চত্বরে দাঁড়ানো বছর আঠাশের এক টোটো চালককে ভোট নিয়ে জিজ্ঞাসা করতে বললেন, ‘‘সিপিএমকে দেখেছি। তৃণমূলকেও দেখলাম। এ বার বিজেপিকে-ই ভোট দেব।’’ জেলার তৃণমূল নেতারাও ঘরোয়া আলোচনায় মেনে নিচ্ছেন, অল্পবয়সিদের মধ্যে বিজেপির প্রভাব বেশ ভালই। মূলত ধর্মীয় মেরুকরণ। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতেই পদ্ম শিবিরের রমরমা বাড়ছে।

বঙ্গ শাসকের কিঞ্চিৎ অস্বস্তির আরও একটি কারণ বীরভূমের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়। নানুর বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল জাহিরুল হকের সঙ্গে। বললেন, ‘‘গ্রাম পঞ্চায়েতই আমাদের সরকার। সেই সরকার গঠনে ভোট দিতে পারলাম না।’’ অভিযোগের তির তৃণমূলের দিকে। বিজেপি প্রার্থী রামপ্রসাদ দাসের অভিযোগ, ‘‘পঞ্চায়েত খেটে খাওয়া মানুষের সরকার। তাঁরাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। যখন মনোনয়ন পত্র জমা দিতে গেলেন তখন তাঁদের মেরে মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়েছে, মহিলাদের নিগ্রহ করা হয়েছে। মানুষ সে সব ভোলেননি। এ বার তৃণমূল জবাব পাবে।’’ রামচন্দ্রের মতে, তৃণমূল গণতন্ত্র মানে না। পঞ্চায়েত ভোটই তার প্রমাণ। বিরোধীদের ওই অভিযোগকে মাছি তাড়ানোর ঢঙেই ওড়ালেন বীরভূমের তৃণমূল জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল। তাঁর সপাট জবাব, ‘‘প্রার্থী তো ওরা দিতে পারেনি। সেই জন্যই তো ভোট হল না। আমাদের দোষ কোথায়!’’

বোলপুর কেন্দ্রের বাসিন্দাদের মধ্যে শাসকের বিরুদ্ধে ক্ষোভ আছে, অসন্তোষ আছে, আছে অভিযোগও। কিন্তু অধিকাংশ ভোটদাতাই স্বীকার করছেন তৃণমূল জমানায় উন্নয়ন হয়েছে। ঝকঝকে রাস্তা, ব্রিজ তৈরি হয়েছে। ‘কন্যাশ্রী’, ‘যুবশ্রী’-সহ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রকল্পগুলির সুবিধা পেয়েছেন সাধারণ মানুষ। বিরোধীরাও সে কথা সরাসরি অস্বীকার করতে পারছেন না। তবে তাঁদের অভিযোগ, উন্নয়নের নামে তৃণমূলের একাংশের আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে। সেটাকে পুঁজি করে দুর্নীতির অভিযোগ তুলছেন তারা। প্রত্যাশিত ভাবেই এই সব অভিযোগকে গুরুত্ব দিতে নারাজ তৃণমূল প্রার্থী। অসিতের মতে, দু-একটা জায়গায় এমন ঘটনা ঘটতেও পারে। তবে তা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তাঁর কথায়, ‘‘উন্নয়ন সর্বত্র পৌঁছেছে। তার সুফল সকলে পাচ্ছেন। কোথায় ছোটখাটো কী হল, তাতে কেউ গুরুত্ব দিচ্ছেন না।’’

উন্নয়নের পাশাপাশি, তৃণমূলের মজবুত সংগঠনের জন্য স্বস্তিতে অসিত। বোলপুরের সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে শুধু নানুর বিরোধীদের দখলে। গত লোকসভা নির্বাচনে নানুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে ৬০ হাজারের বেশি লিড পেয়েছিলেন জোড়াফুলের প্রার্থী। কিন্তু ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে হেরে যায় তৃণমূল। শাসক দল সূত্রের খবর, ওই পরাজয়ের পিছনে দলের অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ কাজ করেছিল। কিন্তু এ বার আর তা হবে না। প্রচারের ধারে এবং ভারে বিরোধীদের কয়েক যোজন পিছনে ফেলে দিয়েছে অনুব্রতের সংগঠন। বীরভূমের তৃণমূল জেলা সভাপতি সম্ভবত তাই হাসতে হাসতে বলছেন, ‘‘আমার বয়স ৬১ বছর। এমন নির্বাচন আগে কখনও দেখিনি। প্রচারে তো বিরোধীদের খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না। ওরা সব বুথে এজেন্ট দিতে পারবে কি না, সন্দেহ! আর না পারলেই আমাকে দোষারোপ করবে। শুধু জয় নয়, ভোটের ব্যবধান বাড়ানোই আমাদের প্রধান লক্ষ্য।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

TMC BJP Politics Lok Sabha Election 2019
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE