Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

এই বঙ্গে ভাল আছি, বলছেন সংখ্যালঘুরা

এ রাজ্যে সংখ্যালঘুরা কেমন অবস্থায় আছেন?

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

মেহবুব কাদের চৌধুরী
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০১৯ ০২:১০
Share: Save:

পড়ন্ত বিকেল। কলকাতা বন্দর এলাকার নাদিয়ালে গঙ্গার ধারে আড্ডায় মশগুল জনা বিশেক যুবক। নিজেদের মধ্যে ওঁরা বলাবলি করছিলেন, নোটবন্দি, জিএসটি চালু হওয়ার আগে পর্যন্ত এ রকম গল্প করার ফুরসতটুকু পেতেন না ওঁরা। দিনভর কারখানায় কাপ়ড় তৈরিতে মগ্ন থাকতেন। কিন্তু নোটবন্দি, জিএসটি চালু হওয়ার পর থেকে ওঁরা এখন কার্যত বেকার। কাজ না থাকায় অবসরের অফুরন্ত সময় ওঁদের। ভিন্ন জেলা থেকে কাজ খুঁজতে আসা শ্রমিকরাও কাজ হারিয়ে নিজ নিজ গ্রামে ফিরে গিয়েছেন।

এ রাজ্যে সংখ্যালঘুরা কেমন অবস্থায় আছেন? এর উত্তর খুঁজতে পা রেখেছিলাম রাজ্যে বস্ত্রশিল্পের অন্যতম ঠিকানা মেটিয়াবুরুজে। সম্প্রতি মেটিয়াবুরুজে গিয়ে জানা গেল, নোটবন্দি, জিএসটি লাগু হওয়ার পরে অনেক ওস্তাগার ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন। রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে কাজের খোঁজে শ্রমিকরাও আর বন্দর এলাকায় পা রাখছেন না।

কলকাতা পুরসভার ১৪১ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্গত সফি কাঠগোলায় পুরুষানুক্রমে প্রায় ষাট বছর ধরে কাপড় তৈরির ব্যবসা করেন ওস্তাগার সরফুল আলম। সরফুলের কথায়, ‘‘আমার অধীনে ৭৫ জন কর্মী কাজ করছেন। নোটবন্দি, জিএসটি চালু হওয়ার পর এখন কর্মীর সংখ্যা মাত্র ১৫। একটি সেলাই তৈরির কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মাত্র একটি কারখানা রেখেই কোনওক্রমে ব্যবসা চালাতে হচ্ছে।’’ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত ছাড়াও বিদেশেও মেটিয়াবুরুজ থেকে তৈরি কাপড় রফতানি হয়। নোটবন্দি আর জিএসটি-র জেরে এখন তুলনায় কাপড় রফতানির হার কমেছে। কলকাতা বন্দর এলাকার অনেক ছোট ব্যবসায়ী বস্ত্র ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন বলে মেটিয়াবুরুজ ঘুরে জানা গেল। হাওড়া হাট সংগ্রাম সমিতির সভাপতি তথা কলকাতা পুরসভার প্রাক্তন তৃণমূল কাউন্সিলর মইনুল হক চৌধুরীর বাড়ি নাদিয়াল। মইনুলের নাদিয়ালের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, একদা রমরমিয়ে চলা তাঁর বস্ত্র কারখানাটি এখন বন্ধ। মইনুলের কথায়, ‘‘আগে আমার এখানে ৪০ জন কর্মী কাজ করতেন। এখন সেখানে ৪ জন। নোটবন্দি , জিএসটি চালু হওয়ার পর এখন কাটা কাপড়ের বেশির ভাগই বাইরের থেকে বানিয়ে নিই। এর ফলে খরচ তুলনায় কম পড়ে।’’ গার্ডেনরিচের আর এক ওস্তাগার মেহতাব আলিরও একই দুর্দশা। মেহতাবের কথায়, ‘‘মেটিয়াবুরুজের বেশিরভাগ মানুষ লেখাপড়া কম জানেন। জিএসটিতে ছোট শিল্পের ছাড় পাওয়া গেলেও সেই ছাড় মিলতে অতিরিক্ত কর্মী রাখার জন্য অনেক ছোট ব্যবসায়ী ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন। আগের তুলনায় আমিও কর্মীর সংখ্যা অর্ধেক কমিয়ে দিয়েছি। কাপড় তৈরির সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছি।’’

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, ভারতে মোট জনসংখ্যার ২০.২ শতাংশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত। এর মধ্যে ১৪.২ শতাংশ মুসলিম। বাকি ৬ শতাংশ শিখ, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন-সহ অন্যান্যরা। রাজ্যে আবার মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত। রাজনীতিক বিশ্লেষকরা জানাচ্ছেন, ভারতে মুসলমানরা গত কয়েক বছর ধরে যে পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন অতীতে এ রকম অবস্থার কখনও সৃষ্টি হয়নি। সাম্প্রদায়িক হিংসার বিভিন্ন ছবি ঘিরে সাম্প্রতিক সময়ে শোরগোল উঠেছে সোশ্যাল মিডিয়া-সহ সমস্ত জায়গায়। আমজনতার মধ্যেও এ নিয়ে চর্চা-বিতর্ক চলছেই। সাম্প্রতিক রাজনীতিতে ‘ধর্ম’ নিয়ে মাতামাতি করা হচ্ছে এবং ‘অসহিষ্ণুতা’র পরিবেশে সংখ্যালঘুদের ‘টার্গেট’ করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে মুসলিমদের একাংশ নীরব বলে জানাচ্ছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশ। কারণ, তাঁরা কোনও ভাবে নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন বলেই মনে করছেন অনেকে।

তবে ভারতের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় এ রাজ্যে সংখ্যালঘুরা অনেকটাই নিরাপদ বলে মনে করছেন সমাজের বিভিন্ন পেশার মানুষরা। হাওড়ার একটি কলেজের শিক্ষক তথা সংখ্যালঘুদের নিয়ে কাজ করা ‘বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চ’-এর সভাপতি সামিরুল ইসলামের কথায়, ‘‘ভারত সহনশীল দেশ। আমরা দেশের জন্য গর্ব অনুভব করি। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে দেশজুড়ে যে ভাবে অসহিষ্ণুতার আবহাওয়া ছড়িয়েছে তাতে ভোটে প্রভাব পড়তে বাধ্য। কাশ্মীরের পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলার ঘটনার পরবর্তী সময়ে যে ভাবে দেশপ্রেমকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হচ্ছে, তা ভোটের আগে রাজনৈতিক জিগির ছাড়া কিছু নয় বলে মনে করেন অধ্যাপিকা মীরাতুন নাহার। তাঁর কথায়, ‘‘সংখ্যালঘুরা এই গিমিকে খুব বেশি প্রভাবিত হবেন না বলে মনে করি।’’

গৌরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেহেদি হাসান মনে করেন, ‘‘ধর্ম আর রাজনীতিকে মিশিয়ে সরবত করে খাওয়ানো হচ্ছে। দেশ যে সবার, সেই আত্মবিশ্বাসের ভিত নাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সব সময়। গোরক্ষকদের তাণ্ডবও কারও অজানা নয়।’’ বৌদ্ধ ধর্মগুরু অরুণজ্যোতি ভিক্ষু। তাঁর কথায়, ‘‘যে কোনও সরকারের উচিত, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেওয়া। কিন্তু দেশে গত কয়েক বছর ধরে দলিত ও মুসলিমদের উপর যে ভাবে ক্রমাগত আঘাত এসেছে তা চিন্তার বিষয়।’’ পেশায় শিক্ষক শেখ শামসুদ্দিনের কথায়, ‘‘এ রাজ্যের শাসকেরা সংখ্যালঘুদের মনে একটা আস্থা অর্জন করতে পেরেছে, এটা মানতেই হবে।’’

ওয়েস্টবেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশন অব খ্রিস্টান স্কুলস-এর সম্পাদক মলয় ডি কোস্টার পর্যবেক্ষণ, ‘‘অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘুরা বেশ নিরাপদেই রয়েছে। এখানে সংখ্যালঘু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি শান্তিপূর্ণভাবেই কাজ করছে। এটা একটা শুভ ইঙ্গিত।’’

বঙ্গীয় ইমাম অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মহম্মদ ইয়াহিয়ার কথায়, ‘‘বিভাজন ও সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি সামগ্রিক ভাবে দেশের পক্ষে অমঙ্গল। আগের তুলনায় মানুষ এখন বেশি সচেতন। গত কয়েক বছরে দেশে যে কাণ্ড ঘটছে সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে গ্রামবাংলার মুসলিমদের অজানা নয়। তৃণমূল শাসিত এই রাজ্যে সংখ্যালঘুরা অনেকটাই নিরাপদ। তাঁরা তৃণমূলের পক্ষেই রায় দেবেন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE