Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

‘ভোট তো ফের হচ্ছে, এই ক্ষতির দায় কে নেবে!’

২০১৪ সালে লোকসভা ভোটের দিন বিকেলে এলাকারই এক বাগানবাড়িতে বস্তায় রাখা বোমা ফেটে মারা যান রফিক আলি নামে এক যুবক।

শোকার্ত: গত লোকসভা ভোটে বোমা বিস্ফোরণে মৃত রফিকের মা হাসিনা বিবি। রবিবার। ছবি: সুদীপ ঘোষ

শোকার্ত: গত লোকসভা ভোটে বোমা বিস্ফোরণে মৃত রফিকের মা হাসিনা বিবি। রবিবার। ছবি: সুদীপ ঘোষ

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ মে ২০১৯ ০২:১১
Share: Save:

পাঁচ বছরে ১২ বার অস্ত্রোপচার হয়েছে মধ্যমগ্রামের নদীভাগের যুবক আরাফত আলির। এখনও দু’চোখে ঠিক মতো দেখতে পান না। সর্বাঙ্গে স্পষ্ট স্‌প্লিন্টারের ক্ষতের চিহ্ন।

গত লোকসভা ভোটের সময়ে কিশোর আরাফতের মাধ্যমিক দেওয়ার কথা ছিল। সেই পরীক্ষা এ বার দিয়েছেন তিনি। ২০১৪ সালে লোকসভা ভোটের দিন বিকেলে এলাকারই এক বাগানবাড়িতে বস্তায় রাখা বোমা ফেটে মারা যান রফিক আলি নামে এক যুবক। পরপর কয়েকটি শক্তিশালী বোমা ফেটে গুরুতর জখম হয় আরাফত-সহ কয়েক জন কিশোর। সে দিনের আহত কিশোরদের বেশির ভাগ এখন পড়াশোনা ছেড়ে দোকানে বা জোগাড়ের কাজে ব্যস্ত। শুধু আরাফতই হাল না ছেড়ে ফের এ বছর মাধ্যমিক দিয়েছেন।

পাঁচ বছর পরে আরও একটি লোকসভা ভোটের দিন, রবিবার, এলাকায় ঢুকতেই সারা শরীরে স্‌প্লিন্টারের ক্ষতের চিহ্ন নিয়ে সেই ছেলেরা উগরে দেয় ক্ষোভের কথা। রবিউল ইসলামের একমাত্র ছেলে সাইফুল তখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। কোন ক্লাসে পড়? মাথা নিচু করে সে অস্ফুটে বলে ওঠে, ‘‘পড়ি না, রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করি।’’ হাত-পা আর পিঠে সে দিনের চিহ্ন দেখিয়ে সে বলে, ‘‘চিকিৎসার খরচ সামলাতে না পেরে পড়া ছেড়ে কাজে নামতে হয়েছে।’’ সে সময়ে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র আরশাদুল আলি খানকেও পড়া ছেড়ে জামাকাপড় ধোয়া, ইস্ত্রির কাজ করতে হচ্ছে। এত দিনে একাদশ শ্রেণিতে পড়ার কথা ছিল শাহিদ আলি নামে আরও এক কিশোরের। এখন পড়ছে অষ্টম শ্রেণিতে। তার মাথায় অস্ত্রোপচার করে স্‌প্লিন্টার বার করতে হয়েছে। সেই চিহ্ন দেখিয়ে শাহিদ বলে, ‘‘হাসপাতালে ছিলাম অনেক দিন, তাই পড়াশোনা করতে পারিনি।’’

সে দিনের ঘটনায় মৃত রফিকের বাড়ি যেতেই তাঁর মা হাসিনা বিবি বলেন, ‘‘ছেলেটা বোমা কী জিনিস জানত না। প্রিয় খাবার খেতে গিয়ে মরেই গেল। তার পরেও পার্টির কেউ কেউ বলেছে, ছেলেটা নাকি অ্যাক্সিডেন্টে মরে গিয়েছে।’’ দাদা ইউনুস আলির ক্ষোভ, ‘‘ভাই মারা যাওয়ার পর থেকে সাহায্য তো দূর, কারও দেখা পাইনি। কাকে ভরসা করব বলুন তো?’’

সে বছর ভোট উপলক্ষে নদীভাগের ওই বাগানবাড়িতেই তৃণমূলের দলীয় কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যাহ্নভোজের আসর বসেছিল। খাওয়া সেরে বিকেলের দিকে বাড়ি চলে যান কর্মী-সমর্থকেরা। এ দিকে, উদ্বৃত্ত ভাত-মাংস খাওয়ার টানে বাগানবাড়িতে ঢুকে পড়ে একদল কিশোর। সঙ্গে ছিলেন রফিকও। বাগানবাড়ির এক কোণে একটি বস্তায় রাখা ছিল কয়েকটি বোমা। কিশোরেরা বোমাগুলি নিয়ে নাড়াচাড়া করতেই তা সশব্দে ফাটে। সারা শরীরে স্‌প্লিন্টার ঢুকে যায় তাদের। পরে হাসপাতালে মারা যান রফিক। আশঙ্কাজনক অবস্থায় কিশোরদের ভর্তি করা হয় বারাসত হাসপাতালে। এর পর থেকে দীর্ঘদিন চিকিৎসা চলতে থাকে আহত কিশোরদের। তৃণমূলের অভিযোগ ছিল, বিরোধী দলের দুষ্কৃতীরা বোমাগুলি রেখে গিয়েছিল।

এ দিন আরাফতের বাড়ি যেতেই তাঁর মা আশুরা বিবি বলে ওঠেন, ‘‘এত দিন পরে কী করতে এসেছেন!’’ চোখ, মুখ-সহ সর্বাঙ্গে আঘাতে জর্জরিত ছেলের ১২ বার অস্ত্রোপচারের পরেও হাসপাতালে হাসপাতালে ছুটে বেড়াচ্ছেন মা-বাবা। ঘটনার কিছু দিন পরে আরাফতের চিকিৎসার জন্য টাকা দিতে এসেছিল এক রাজনৈতিক দল। ‘‘খাওয়ার আসরে যারা বোমা রেখে যায়, তাদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলাম,’’ বললেন আশুরা।

কারও সাহায্য না নিয়ে এখনও ছেলের চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। বাড়ির সামনের দোকানটি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আরাফতের বাবা ইসমাইল বলেন, ‘‘আমি কাজে যাই। আশুরা ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে ছোটে। কে দেখবে দোকান?’’ ভিতর থেকে আশুরা বলেন, ‘‘ছেলেটা এত বছর বসে ছিল। এ বার শুধু মনের জোরে মাধ্যমিক দিয়েছে। ভোট তো ফের হচ্ছে, এই ক্ষতির দায় কে নেবে!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Lok Sabha Election 2019 Violence Death
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE