Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Lok Sabha Election 2019

একটা মোয়া কত ভাগ হবে, সেটাই চ্যালেঞ্জ

কুলতলির আসনটি সিপিএমের জোট প্রার্থীর কাছে হেরেছিল তৃণমূল। সব ক’টি আসনে তৃতীয় স্থানে ছিল বিজেপি।

সৌরভ দত্ত 
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০১৯ ০৩:৪১
Share: Save:

কুলতলির গোপালগঞ্জ পঞ্চায়েত বাজারে চায়ের দোকানে বসেছিলেন জেলা পরিষদে সিপিএমের প্রাক্তন বিরোধী দলনেতা। বিজেপির পথসভায় বক্তা হিসেবে তাঁর নাম ঘোষণা হতে বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়ালেন। চেনা মুখের পতাকা বদল হতে দেখে বিস্মিত এক পথচারীর প্রশ্ন, ‘তুমি কবে এলে’! জয়নগর লোকসভা কেন্দ্রে এ ধরনের অপ্রত্যাশিত দৃশ্যপটেই ‘অন্য রকম ভোট’-এর অশনিসঙ্কেত দেখছেন ভোটারেরা। এই ‘অন্য রকম’ শব্দবন্ধনীর অগ্রভাগে রয়েছে বিভাজনের রাজনীতি। তৃণমূলের অন্দরে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের অভিযোগ এবং নানা হিসেব-নিকেশ।

জয়নগর, কুলতলি, ক্যানিং-পূর্ব, ক্যানিং-পশ্চিম, বাসন্তী, গোসাবা, মগরাহাট পূর্ব— এই সাতটি বিধানসভা নিয়ে জয়নগর লোকসভা কেন্দ্র। তিন বছর আগে বিধানসভা ভোটে কুলতলি ছাড়া বাকি সব ক’টিতেই জয়ী হয়েছিলেন তৃণমূল প্রার্থীরা।

কুলতলির আসনটি সিপিএমের জোট প্রার্থীর কাছে হেরেছিল তৃণমূল। সব ক’টি আসনে তৃতীয় স্থানে ছিল বিজেপি। গত বছর পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোটবাক্সে আরও কিছুটা পথ এগিয়েছে গেরুয়া বাহিনী। বস্তুত, জয়নগর এমন একটি কেন্দ্র, যেখানে তৃণমূলের পাশাপাশি বাম, বিজেপি, এসইউসি, কংগ্রেসেরও উল্লেখযোগ্য সংগঠন রয়েছে। তা বলে গত লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থী প্রতিমা মণ্ডলের এক লক্ষ আট হাজারের ব্যবধানের কাছাকাছিও কি কোনও বিরোধী প্রার্থী পৌঁছতে পারবেন?

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

কংগ্রেসের দখলে থাকা জয়নগর-মজিলপুর পুরসভার অদূরে চায়ের দোকানের আড্ডায় জয়ন্ত মতিলাল নামে এক প্রৌঢ় বলেন, ‘‘মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে আছে।’’ আড্ডার শুরুতেই বোঝা গেল ক্ষোভের আধার হল বিভাজনের রাজনীতি। জয়নগর শহরে সেই রাজনীতি ভোটবাক্সে এগিয়ে থাকলে অবাক হওয়ার কিছু নেই বলে দাবি করেন ওই প্রৌঢ়। পাশ থেকে এক যুবক মনে করিয়ে দেন, গত ডিসেম্বরে শহরের বুকে ভরসন্ধ্যায় তৃণমূল নেতা সারফুদ্দিন শেখের গুলিবিদ্ধ হয়ে খুনের ঘটনারও প্রভাব পড়বে। যা স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক বিশ্বনাথ দাস এবং এলাকার বর্ষীয়ান তৃণমূল নেতা গৌর সরকারের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব হিসেবেই পরিচিত। যদিও শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশে সে সব এখন অতীত বলেই দাবি করছেন স্থানীয় তৃণমূল নেতারা।

কেন্দ্র এক নজরে - জয়নগর

• মোট ভোটার: ১৬,৪৭,৭৬১
• বুথ: ১৮১০
• ২০১৪-র লোকসভা ভোটে তৃণমূলের প্রতিমা মণ্ডল জয়ী হন। ব্যবধান ছিল ১,০৮,৩৮৪
• ২০১৬-র বিধানসভা ভোটে সাতে সাত হয়নি। জয়নগর, ক্যানিং পূর্ব, ক্যানিং পশ্চিম, বাসন্তী, গোসাবা, মগরাহাট পূর্ব— এই ছ’টি বিধানসভায় জয় পেয়েছিল তৃণমূল। কুলতলিতে জয়ী হয়েছিলেন বাম-কংগ্রেস জোট প্রার্থী রামশঙ্কর হালদার

সাত কেন্দ্রের যাত্রাপথ যত এগিয়েছে ততই ‘অন্য রকম ভোটে’র তাৎপর্য বুঝিয়েছেন বাসিন্দারা। গ্রীষ্মের দুপুরে পূর্ব দেবীপুরে একচালার নীচে তাস পিটছিলেন গাঁয়ের প্রবীণেরা। ভোটের খবর নিতে ক্ষিতীশ মণ্ডল বলেন, ‘‘বিজেপি তো সবে খাতা খুলেছে। ইয়ং জেনারেশন করছে। তবে অত সহজে জয়নগর থেকে তৃণমূল হারবে না।’’ গাঁয়ের বুড়োর মুখের কথা শেষ হতে না হতেই ঠিক বিপরীত মুখে বসা এক ব্যক্তি বললেন, ‘‘এখানে রাজনীতি মানে শেল্টার। শেল্টার নেই বলে সিপিএম-এসইউসি থেকে লোক বিজেপি’তে যাচ্ছে। এই ভোটে কী হবে অনুমান করা মুশকিল!’’ আশ্রয়ের এই রাজনীতিতে মইপীঠের বাসিন্দা মর্জিনা শেখেরা আয়লার ক্ষতিপূরণ না-পেয়ে এসইউসির সমর্থক। আবার বাসন্তী বাজারের ব্যবসায়ী কার্তিক নস্কর বাম প্রার্থী সুভাষ নস্করের ভাবমূর্তির উপরে বাজি ধরছেন।

তৃণমূলের আমলে উন্নয়ন প্রশ্নে শাসক দলের দাবিদাওয়ার উপরে কার্যত কেউই সংশোধনী দিচ্ছেন না। সেই অঙ্কে তৃণমূল প্রার্থীকে এগিয়েও রাখছেন। তবে পুনশ্চ হিসেবে রেখে দিচ্ছেন কিছু সংশয়। মেরুকরণের রাজনীতির আবহে ক্যানিং স্টেশন লাগোয়া ফল ব্যবসায়ী বুবাই মল্লিকের কথায়, ‘‘ক্যানিংয়ে এখন হাওয়া গরম। কে কোথায় ভোট দেবে বোঝা মুশকিল!’’ আরও এক ব্যবসায়ী সনাতন দেবনাথ বলেন, ‘‘বাসন্তী, গোসাবা ঘুরুন। অনেক লোক তো আমাদের কাছে আসে। যা শুনছি হাওয়া চার দিকে কঠিন।’’ জীবনতলায় এক তৃণমূল নেতা বলেন, ‘‘বাসন্তীতে আরএসপি লড়াই দেবে। গোসাবা, মগরাহাটে যা ভাবা হচ্ছে, তত লিড না-ও হতে পারে। ক্যানিং পশ্চিমেও বিধানসভার লিড ধরে রাখা মুশকিল। তবে আসন আমাদেরই থাকবে।’’

এই নিশ্চয়তায় তৃণমূলের এই অংশের কাছে কেকেআরের আন্দ্রে রাসেল হলেন ক্যানিং-পূর্বের বিধায়ক শওকত মোল্লা। যেখানে এখনও পর্যন্ত বিরোধীরা কার্যত কোনও প্রচার করতে পারেননি। তা নিয়ে বিরোধীদের অনুযোগও রয়েছে। ঝোড়োর মোড়ে সে প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জয়নাল বৈদ্য, দুখে লস্করেরা বলেন, ‘‘আমাদের অন্য রকম চিন্তাভাবনা করলে হবে না। শওকত মোল্লা, প্রতিমা ছাড়ব না।’’

এই প্রতিক্রিয়া শাসক দলের প্রার্থীর মুখে হাসি ফোটানোর পক্ষে যথেষ্ট। তবে সুন্দরবন উপকূলবর্তী লোকসভা কেন্দ্রের পথেঘাটে আবার ‘বহুমুখী ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র’ও তো রয়েছে! ঘূর্ণির সম্ভাবনা কানাঘুষো শোনাও যাচ্ছে। বাহিরবেনার এক তৃণমূল সমর্থক বলেন, ‘‘মমতাদি আট বছরে যা কাজ করেছেন তাতে দল এক ভাবে চললে আরও ৩০ বছর ক্ষমতায় থাকবে। কিন্তু নীচুতলার কর্মীদের অনেকের রাগ হল, খেটে দল করেও তারা কিছু পায়নি। যারা দু’দিনের জন্য এসেছে,

তারাই সব!’’ তবে যে কেন্দ্রে কমবেশি ৪০ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোট রয়েছে সেখানে ‘ঘূর্ণি’র এমন পূর্বাভাস আদৌ কতটা কাজ করবে তা হলফ করে কেউ বলতে পারছেন না।

বামেদের কাছে আবার ‘ঘূর্ণি’র প্রভাব ভিন্ন। আরএসপি প্রার্থী সুভাষ নস্করের কথায়, ‘‘তৃণমূলকে জব্দ করতে গেলে বিজেপি-কে ভোট দিতে হবে, বাম সমর্থকদের একাংশের মধ্যে এই ধারণা কাজ করছে। তবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে যারা শাসক দলের প্রতি বীতশ্রদ্ধ, তাঁদের ভোট আমরাই পাব। তা ছাড়া, প্রার্থী হিসেবে জয়নগরের মানুষের কাছে আমার পরিচিতি সব চেয়ে বেশি। এমনও হতে পারে, কোথা থেকে এত ভোট পেলাম তা দেখে আমরাই অবাক হয়ে গেলাম!’’

গদখালির ঘাটে দাঁড়িয়ে বিজেপি প্রার্থী চিকিৎসক অশোক কাণ্ডারী বলেন, ‘‘ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা হলে বের হয়ে যাব।’’ ক্যানিং-পূর্বেও? খানিক থমকে বিজেপি প্রার্থীর মন্তব্য, ‘‘সব জায়গায় হাওয়া ভাল। ওই জায়গাটাই চিন্তার।’’ ভোট হলে সেখানেও ব্যাটে রান আসবে বলে দাবি করছেন বিজেপির চিকিৎসক প্রার্থী। এসইউসি প্রার্থী জয়কৃষ্ণ হালদার বলেন, ‘‘তৃণমূলকে জব্দ করার জন্য বিজেপিতে যোগদানের প্রবণতা আটকাতে পেরেছি। যেখানেই যাচ্ছি, মানুষ কানে কানে বলছেন, বাবু ভোটটা শুধু করান।’’ কংগ্রেস প্রার্থী তপন মণ্ডলেরও দাবি, ‘‘অবাধ নির্বাচন হলে জয়নগরে চমকপ্রদ রেজাল্ট করব।’’

বিরোধীদের এই হিসেব-নিকেশে আমল না দিয়ে তৃণমূল প্রার্থী প্রতিমা বলেন, ‘‘জয়নগর এক নম্বর ব্লকে ভাল ভোট পাব। কুলতলি থেকে এ বার লিড থাকবে। মগরাহাট-পূর্বেও লিড বাড়বে। গোসাবাও ভাল করবে। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি হওয়ার ফলে শেষ পর্যন্ত কী ভাবে সমীকরণ বদলাবে, তা বলা মুশকিল।

তবে জয়ের ব্যাপারে আমি আশাবাদী। একটা দল কোনও উন্নতির কথা বলে না। শুধু বিভাজনের রাজনীতি করছে। এ জন্যই সংখ্যালঘুদের সমর্থন আমাদের পক্ষে থাকবে। শিক্ষিত মানুষের ভোট আমরাই পাব।’’

মোয়ার কেন্দ্রে বিভাজনের হাওয়া যা উৎপন্ন করছে, সেটাই আপাতত জয়নগরের ভোটপুরাণ!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Lok Sabha Election 2019 Jayanagar জয়নগর
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE