মৈনাক সরকার
নিউইয়র্ককে বলা হয় ‘মেল্টিং পট’। গোটা পৃথিবী থেকে মানুষ সমবেত হন সে শহরে। নানা ভাষা, নানা ধর্ম, নানা জাতি, নানা সংস্কৃতি মিলেমিশে একাকার হয় নিউইয়র্কে।
সেই নিউইয়র্ককেই বিশ্বের সামনে একটা প্রতীক হিসেব তুলে ধরে আমেরিকা— বিশ্বজনীনতার প্রতীক। সমস্ত বিভিন্নতাকে আপন করে নেওয়ার যে অসামান্য শক্তি নিউইয়র্কের, সেটাই আসল মার্কিন সংস্কৃতি— এটাই বার্তা। এই বার্তায় ভর করেই গোটা বিশ্বের রাজধানী হয়ে উঠতে চেয়েছে আমেরিকা।
এই আমেরিকার কিন্তু একটা অন্য স্বরও রয়েছে, একটা অন্য রূপও রয়েছে। মৈনাক সরকারের অবিমৃষ্যকারিতা আমেরিকার সেই রূপটাকে আরও প্রকট ভাবে সামনে এনে দিল আজ।
গত কয়েক বছরে মার্কিন মুলুকে কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা কমেছে, আর্থিক প্রগতি কমেছে। আটলান্টিকের পাড়ে কেউ কেউ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে শুরু করেছেন। ভারতীয় সম্প্রদায় এবং বিদেশ থেকে আমেরিকায় পাড়ি জমানো আরও নানা সম্প্রদায়ের দিকে অন্য দিকে চোখে তাকানো শুরু হয়েছে যেন। মার্কিন নাগরিকদের প্রাপ্য যে সব সুযোগ-সুবিধা, তাতে ভিন্ দেশিরা ভাগ বসাচ্ছে— এমন একটা ভয়ঙ্কর ধারণা ভিতরে ভিতরে চারিয়ে যাচ্ছিল অনেক দিন ধরেই। ডোনাল্ড ট্রাম্প নামে একটি অধুনা উদ্ভাসিত চরিত্র সেই ভয়ঙ্কর ধারণাটাকে আকার দেওয়ার খেলায় মেতেছেন। গোটা বিশ্বকে উদ্বাহু স্বাগত জানানোর পথ থেকে না সরলে আমেরিকার বিপদ আরও বাড়বে— এই শঙ্কার আগুনে অক্সিজেন জোগাতে শুরু করেছেন ট্রাম্প। সেই আগুন যে ধিকিধিকি কতটা ছড়িয়েছে, মৈনাক সরকারকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় শুরু হওয়া আলোচনায় তা বেশ স্পষ্ট।
মৈনাক সরকার নামক ব্যক্তি এখন গৌণ। সোশ্যাল মিডিয়ায় মুখ্য আলোচ্য এখন তাঁর জাতিসত্তা। আততায়ী হিন্দু অথবা মুসলিম, আততায়ী ভারতীয়, আততায়ী বাঙালি— এমন নানা অপ্রাসঙ্গিক কথার ঝড় মার্কিন মুলুকে। আমেরিকার নানা প্রান্তে বার বার এমন বন্দুকবাজের হানা কেন, সে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে না। আমেরিকার ঘরে ঘরে এত বন্দুক কেন, সে কথাও আলোচনায় নেই। আসলে, আমেরিকায় শিক্ষা এবং কাজের ক্ষেত্রে ভিন্ দেশিদের (ভারতীয় তথা এশীয়) যে রকম অগ্রগতি তা ঈর্ষণীয় হয়ে উঠছে মার্কিন মুলুকের অনেকের কাছেই। এক সময় গুয়াহাটিতে কলকাতার উদয়ে অসমিয়া মানসে যে নিরাপত্তাহীনতার বোধ চারিয়ে গিয়েছিল, সিলিকন ভ্যালিতে বেঙ্গালুরুর উদয় দেখে আমেরিকা এখন সম্ভবত সেই নিরাপত্তাহীনতার ভূতই দেখছে।
কিন্তু, আমেরিকা অবশ্যই সুদীর্ঘ সময় ধরে এক সুবৃহৎ গণতন্ত্র। উদার মানবিকতা আর সর্বত্রগামী গণতন্ত্রের শিকড় সে দেশের মাটির বেশ গভীরে। তাই পাল্টা স্বরটাও উঠে আসছে। যে জাতিবিদ্বেষী ঝড় তোলার চেষ্টা হচ্ছে, তার প্রতিরোধটাও আমেরিকার মাটিতেই তৈরি হচ্ছে। আমেরিকা আর বিশ্বজনীনতা যে সমার্থক, নিউইয়র্ক যে এখনও ‘মেল্টিং পট’, তা বোঝানোর জন্য আজও সক্রিয় মার্কিন জনগোষ্ঠীর এক বিরাট অংশ।
অতএব, অন্য রকম একটা সন্ধি ক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে জর্জ ওয়াশিংটন, আব্রাহাম লিঙ্কন আর বারাক ওবামার দেশ। কারণ আমেরিকা ডোনাল্ড ট্রাম্পেরও দেশ।
পথ খুঁজে নিতে হবে আমেরিকাকেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy