Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

আলোচনা না করেই সফর রাজনাথের, ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী

রীতি না মানার অভিযোগ উঠল। অভিযোগ এক্তিয়ারের সীমা লঙ্ঘনেরও। ছিটমহলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের সফর ঘিরে এই নিয়েই পরস্পরকে বিঁধছে কেন্দ্র-রাজ্য দুই পক্ষ। স্থলসীমান্ত চুক্তি সংক্রান্ত সংবিধান সংশোধন বিলটি সংসদে উত্থাপনের আগে মঙ্গলবার কোচবিহারে বাংলাদেশ সীমান্ত ও ছিটমহল সংলগ্ন এলাকা ঘুরে দেখেন রাজনাথ।

সুনতালেখোলায় মুখ্যমন্ত্রী। কোচবিহারের তিনবিঘা করিডরে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ছবি: দীপঙ্কর ঘটক ও হিমাংশুরঞ্জন দেব।

সুনতালেখোলায় মুখ্যমন্ত্রী। কোচবিহারের তিনবিঘা করিডরে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ছবি: দীপঙ্কর ঘটক ও হিমাংশুরঞ্জন দেব।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৩৪
Share: Save:

রীতি না মানার অভিযোগ উঠল। অভিযোগ এক্তিয়ারের সীমা লঙ্ঘনেরও। ছিটমহলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের সফর ঘিরে এই নিয়েই পরস্পরকে বিঁধছে কেন্দ্র-রাজ্য দুই পক্ষ।

স্থলসীমান্ত চুক্তি সংক্রান্ত সংবিধান সংশোধন বিলটি সংসদে উত্থাপনের আগে মঙ্গলবার কোচবিহারে বাংলাদেশ সীমান্ত ও ছিটমহল সংলগ্ন এলাকা ঘুরে দেখেন রাজনাথ। কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদলের সঙ্গে রাজ্য প্রশাসনের কাউকেই দেখা যায়নি। এর বাইরেও রাজনাথের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী বা রাজ্যের শীর্ষ আমলাদের কারও সাক্ষাৎ হয়নি।

কেন এমনটা ঘটল? এখানেই রীতি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মঙ্গলবার ফেসবুকে নিজের পোস্টে মুখ্যমন্ত্রী প্রশ্ন তুলেছেন, ছিটমহল সংলগ্ন এলাকা রাজ্যের এক্তিয়ারভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কেন একতরফা ভাবে সেখানে সফরে আসবেন? কেন সফরের আগে রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা করা হবে না? বিষয়টিকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিপন্থী বলেও মন্তব্য করেছেন। রাজ্য সরকারের কোনও প্রতিনিধিকে সঙ্গে না-নিলেও রাজনাথ যে ভাবে দার্জিলিংয়ের দলীয় সাংসদ সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়াকে সঙ্গী করে এলাকায় ঘুরেছেন, তা নিয়েও ঘনিষ্ঠ মহলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মমতা। তৃণমূল নেতৃত্বের অভিযোগ, অহলুওয়ালিয়া স্থানীয় সাংসদ না-হয়েও রাজনাথের সফরে ছড়ি ঘুরিয়েছেন।

প্রশাসন সূত্রের খবর, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের বিষয়টি কেন্দ্র শুক্রবার জানায় রাজ্য সরকারকে। কিন্তু তা নিয়ে আলোচনার কোনও প্রস্তাব বা সফরসঙ্গী হিসেবে রাজ্য প্রশাসনের কাউকে কেন্দ্রের তরফে থাকতে বলা হয়নি। শুধুমাত্র রাজনাথ আসবেন, এই খবরটুকুই জানানো হয়। রাজ্য সরকার বিষয়টি ভাল ভাবে নেয়নি। শনিবারই কেন্দ্রকে জানিয়ে দেওয়া হয়, রাজ্যের শীর্ষ অফিসারেরা নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করছেন। ফলে তাঁরা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে বা তাঁর সফরের দেখভাল করতে পারবেন না। মুখ্যমন্ত্রীও জানিয়ে দেন, এত দেরি করে জানানোয় তাঁর উত্তরবঙ্গ সফর বাতিল করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে রাজনাথের সঙ্গে তাঁর দেখা হবে না।

মমতার অভিযোগ অবশ্য মানছে না কেন্দ্র এবং বিজেপি নেতৃত্ব। তাঁর সফরে রাজ্য সরকারের প্রতিনিধি কেন নেই? তিনবিঘায় রাজনাথকে প্রশ্ন করা হলে তিনি এ দিন বলেন, “এটা সীমান্ত পরিদর্শন। এখানে রাজ্য সরকারের প্রতিনিধির থাকার কথা নয়।” আর, বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহ দাবি করেন, ‘‘প্রোটোকল মেনেই গত ২৫ মার্চ রাজ্যপাল, মুখ্যমন্ত্রী, মুখ্যসচিব এবং স্বরাষ্ট্রসচিবের দফতরে চিঠি দিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এই সফরের কথা জানিয়েছিল। মমতাই প্রোটোকল মানেন না। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রেও মানেননি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর রাজনাথ প্রথম এ রাজ্যে এলেন। কিন্তু মমতা তাঁর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎও করলেন না!’’

কোচবিহারের ছিটমহলে মন্ত্রীর সঙ্গে দার্জিলিঙের বিজেপি সাংসদ সিংহ অহলুওয়ালিয়া থাকলেন কেন? জবাবে অহলুওয়ালিয়া বলেন, ‘‘উত্তরবঙ্গ থেকে নির্বাচিত হওয়ায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তিনবিঘা গিয়েছি। এতে কোনও রাজনীতি নেই।’’ পাল্টা অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী নিজেই রাজনীতি করতে অভ্যস্ত। তাই দার্জিলিঙে তিনি সরকারি সফরে এলেও, সাংসদ হিসেবে আমাকে জানানো হয় না। উনি অযথা রাজনীতি করেন বলেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে এক জন বিডিওকে পাঠান। এটাই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর অবমাননা।’’

শুধু অহলুওয়ালিয়া নয়, প্রশ্ন উঠেছে এ দিন রাজভবনে রাজনাথের সঙ্গে রাজ্য বিজেপি সভাপতি রাহুল সিংহের উপস্থিতি নিয়েও। ছিটমহল থেকে কলকাতায় ফিরে রাজভবনে ওঠেন রাজনাথ। সেখানে রাহুলকে নিয়ে তিনি রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর সঙ্গে দেখা করেন। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ট্যুইটারে রাজনাথ ও রাজ্যপালের যে ছবি প্রকাশিত হয়, সেখানেও রাহুলকে দেখা যায়। মুখ্যমন্ত্রী প্রশ্ন তোলেন, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করলে কেন রাজ্য বিজেপি সভাপতি সেখানে থাকবেন? এর পরেও এই সফরকে রাজনৈতিক না-বলে সরকারি বলা হয় কী করে? তাঁর কথায়, ‘‘তাঁদের আলোচনা যদি রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে হয়, তা হলে সেই খবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক কেন ট্যুইট করবে? আর আলোচনা যদি সরকারি বিষয় নিয়ে হয়, তা হলে সেখানে কেন রাহুল সিংহ হাজির ছিলেন?’’


কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েও সুযোগ পাননি ছিটমহলের বাসিন্দাদের একাংশ।
হতাশা নিয়েই তাঁদের ফিরতে হয়। সোমবার হিমাংশুরঞ্জন দেবের তোলা ছবি।

এ ব্যাপারে রাহুলের বক্তব্য, ‘‘এটা সরকারি বৈঠক হলে আমি থাকতাম না। সৌজন্য সাক্ষাৎ বলেই ছিলাম।’’ রাজ্য বিজেপি বরং পাল্টা প্রশ্ন তুলছে, অহলুওয়ালিয়া বা রাহুলকে যে মমতা এত অভিযোগ করছেন, সেই তিনি প্রায়শ জেলার প্রশাসনিক বৈঠকে দলীয় নেতাদের সঙ্গে রাখেন কেন?

তবে রাজনৈতিক-প্রশাসনিক চাপানউতোরের পাশাপাশি, এ দিন ছিটমহলের তরফেও অভিযোগ এড়াতে পারেননি রাজনাথ। সকাল থেকেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর জন্য অপেক্ষা করছিলেন ছিটমহলের বাসিন্দাদের প্রতিনিধিদল। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্তারা তাঁদের মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার জন্য নির্দিষ্ট ঘেরাটোপে নিয়ে গিয়ে হাজিরও করেছিলেন। কিন্তু এর পরেই বিপত্তি ঘটে। প্রতিনিধিদলের অভিযোগ, হঠাৎই অহলুওয়ালিয়ার নির্দেশে ওই প্রতিনিধিদলের কাছে থেকে স্মারকলিপিটি নিয়ে চলে যাওয়া হয়। খানিক পরে তা ফিরিয়ে দিয়ে জানানো হয়, ‘‘দুঃখিত। মন্ত্রী দেখা করতে পারছেন না। সময় নেই ওঁর।’’ ওই দলের অন্যতম সদস্য, ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সহকারী সম্পাদক দীপ্তিমান সেনগুপ্ত বলেন, ‘‘আমরা অপেক্ষায় ছিলাম। বিপত্তি বাধালেন সাংসদ অহলুওয়ালিয়া।’’ প্রতিনিধিদলের ক্ষোভ ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে ছিটমহলের বাসিন্দাদের মধ্যে। তাঁদের অনেককেই বলতে শোনা যায়, ‘‘আমাদের প্রতিনিধিদের ডেকে নিয়ে এই অপমানটা না করলেও পারতেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।’’ দীপ্তিমান বলেন, ‘‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ছিটমহলে আসা নিছকই লোক দেখানো। না হলে ছিটমহলের মানুষের সঙ্গে কথা না বলেই ফিরে যান?’’ অহলুওয়ালিয়া পরে বলেন, ‘‘সমন্বয় কমিটির সঙ্গে তৃণমূলের যোগ আছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কে দেখা করবেন তা আমি ঠিক করি না। তাঁরা কেন মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে পারেননি, তা আমি জানি না।’’


কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ সোমবার এসেছিলেন কোচবিহারে।
তিনবিঘা করিডরে সেই ছবি মোবাইলে ধরতে ব্যস্ত নিরাপত্তারক্ষীরা। সন্দীপ পালের তোলা ছবি।

তবে ছিটমহলের বাসিন্দাদের অন্য সংগঠন ইউনাইটেড কাউন্সিলের পক্ষ থেকে অবশ্য সরাসরি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেই স্মারকলিপি দেওয়া হয়। সংগঠনের উপদেষ্টা দেবব্রত চাকী বলেন, “আমরা সরাসরি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতেই স্মারকলিপি তুলে দিয়েছি।’’ ছিটমহলে পা রাখা প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ তিনবিঘায় দাঁড়িয়ে বলেছেন, “স্থলসীমান্ত বিল কবে কার্যকর হবে, তা নিশ্চিত ভাবে বলা কঠিন। আমরা চাই ওই বিল দ্রুত পাশ হোক। কেন্দ্র শীঘ্রই তা সংসদে পেশ করবে।”

আজ, বুধবার উত্তর ২৪ পরগনার আংরাইল সীমান্ত এলাকা ঘুরে দেখার কথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের। বনগাঁ স্টেডিয়ামে সকাল ১০টায় হেলিকপ্টারে নামার কথা তাঁর। সেখান থেকে সড়ক পথে যাবেন প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে সীমান্তবর্তী আংরাইলে। ক’মাস আগে গরু পাচারকারীরা কুপিয়ে খুন করেছিল স্থানীয় বাসিন্দা আরপিএফ জওয়ান নির্মল ঘোষকে। প্রশাসনের একটি সূত্র জানাচ্ছে, নির্মলবাবুর স্ত্রীর সঙ্গেও দেখা করতে পারেন রাজনাথ। আংরাইল সীমান্ত এক সময়ে গরু পাচারের জন্য কুখ্যাত হলেও গত ক’মাসে পাচার কমেছে বলে দাবি বিএসএফের। আংরাইল থেকে ফের বনগাঁ হয়ে রাজনাথ যাবেন বসিরহাটের সামসেরনগরে সুন্দরবন এলাকায়। সেখানে জলসীমান্তের ভাসমান চৌকি ঘুরে দেখবেন তিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE