Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
TMC

হিসেব বুঝে নেব ডিজির কাছে: 'সত্যাগ্রহ' মঞ্চ থেকে পুলিশকে স্পষ্ট হুঁশিয়ারি মমতার

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছেন যে তিনি আরএসএসের পাল্টা হিসেবে ‘জয় হিন্দ বাহিনী’ গড়ে তুলবেন। মঞ্চে দাঁড়িয়েই জ্যোতিপ্রিয় মল্লিককে তাঁর নির্দেশ, অবিলম্বে ব্যারাকপুরের সব ব্লকে জয় হিন্দ বাহিনী গঠন করতে হবে ছাত্র-যুবদের নিয়ে।

নৈহাটিতে মমতা। নিজস্ব চিত্র।

নৈহাটিতে মমতা। নিজস্ব চিত্র।

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ মে ২০১৯ ০০:৩৯
Share: Save:

বিজেপির বিরুদ্ধে তাঁর আক্রমণ স্বাভাবিক ভাবেই ছিল আগের চেয়েও ঝাঁঝালো। বিজেপির টিকিটে ব্যারাকপুর থেকে সদ্য নির্বাচিত সাংসদ অর্জুন সিংহের প্রতি তাঁর হুঁশিয়ারি ছিল অত্যন্ত কঠোর। কিন্তু নৈহাটির ‘সত্যাগ্রহ’ মঞ্চ থেকে বৃহস্পতিবার কঠোরতর হুঁশিয়ারিটা মুখ্যমন্ত্রী দিলেন পুলিশকে। ভাষণের শুরুতে, ভাষণের মাঝ পথে, ভাষণের শেষে—বার বার মুখ্যমন্ত্রী পুলিশ-প্রশাসনকে সতর্কবার্তা দিলেন এবং বুঝিয়ে দিলেন ব্যারাকপুর অঞ্চলে পুলিশের ওপরে নজরদারি আরও বাড়তে চলেছে।

এক রাতের নোটিসে সত্যাগ্রহের আয়োজন। তাই নৈহাটি পুরসভার সামনে এ দিন যে মঞ্চ বাঁধা হয়েছিল, তার সাজসজ্জা খুব একটা চড়া ছিল না। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেজাজ এ দিন ছিল অত্যন্ত চড়া। বিজেপির মতো দলকে তিনি ঘৃণা করেন— ভাষণের একেবারে শুরুর দিকেই বললেন এ কথা। ব্যারাকপুর লোকসভা অঞ্চলে তীব্র সন্ত্রাসের অভিযোগ তুললেন। তার পরেই ঝাঁঝালো আক্রমণ শানালেন রাজ্য পুলিশ ও প্রশাসনের একাংশের বিরুদ্ধে। নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকাকালীন পুলিশ ওই অঞ্চলে যে ভূমিকা পালন করেছে, তীব্র ক্ষোভের সঙ্গে তার নিন্দা করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘লজ্জা করে না? যাঁরা প্রশাসনের এখানে ছিলেন! বাংলাটা কি গুজরাত হয়ে গিয়েছে? কেন বাঙালি মেয়েদের হাত ধরে টানা হবে? মনে রাখবেন, আমি কিন্তু খুব ভয়ঙ্কর লোক।’’

অবাঙালি বহুল শিল্পাঞ্চলে দাড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন অভিযোগ করেছেন, বিজেপি বাঙালি ও অবাঙালিদের সংঘাত লাগানোর চেষ্টা করছে। বেছে বেছে বাঙালি এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপরে হামলা হচ্ছে বলে তিনি ইঙ্গিত দেওয়ার চেষ্টা করেন। কারও নাম না করে তার ঝাঁঝালো প্রশ্ন, ‘‘এত হিম্মত কী করে হয়?’’ তার পরেই বাঙালিদের উদ্দেশে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশ্ন, ‘‘আর বাঙালিও যাঁরা এখানে আছেন, এত ভিতু হলেন কোত্থেকে? এত ভিতু কেন? পালাচ্ছেল কেন? সবাই এলাকায় থাকবেন।’’

আরও পড়ুন: মেদিনীপুরের পর ভাটপাড়া-নৈহাটি, ‘জয় শ্রীরাম’ শুনে ফের মেজাজ হারালেন মমতা

দুপুর একটা থেকে শুরু হওয়ার কথা ছিল এ দিনের সত্যাগ্রহ। জেলা তৃণমূলের সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, নৈহাটির বিধায়ক পার্থ ভৌমিক, জেলা তৃণমূলের পর্যবেক্ষক তথা পানিহাটির বিধায়ক নির্মল ঘোষ, জেলা তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতি তথা উত্তর ২৪ পরগনার জেলা পরিষদের পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ নারায়ণ গোস্বামীরা একটার বেশ আগেই পৌঁছে গিয়েছিলেন অবস্থান মঞ্চে। পরে একে একে হাজির হতে থাকেন ফিরহাদ হাকিম, ব্রাত্য বসু, সুজিত বসু, তাপস রায়, রথীন ঘোষ, শান্তনু সেন, মদন মিত্র, কৃষ্ণা চক্রবর্তীরা। জেলা তৃণমূলের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ নেতানেত্রী পৌঁছে যান বিকেল চারটের মধ্যে। মঞ্চে ভিড় যতই থাকুক, মঞ্চের সামনের ভিড়টা কিন্তু শুরুতে মোটেই উৎসাহব্যঞ্জক ছিল না। কিন্তু বেলা যত গড়ায়, ততই একে একে মিছিল ঢুকতে থাকে দমদম, দক্ষিণ দমদম, বারাসত, মধ্যমগ্রাম, দত্তপুকুর— নানা এলাকা থেকে। মুখ্যমন্ত্রী পৌঁছনোর আগেই সত্যাগ্রহস্থল জমজমাট চেহারা নেয়। সেই জমায়েতের উদ্দেশে কখনও এলাকার পরাজিত তৃণমূল প্রার্থী দীনেশ ত্রিবেদী বলেন, তিনি প্রয়োজনে এখন রোজ ব্যারাকপুরে যাওয়া আসা করবেন। কখনও পার্থ ভৌমিক বলেন, ‘‘ভয় পাবেন না। আপনার ওপর হামলা হলে আমাকে একটা ফোন করবেন। আপনাকে দুটো চড় মারলে একটা চড় আমি খেয়ে আসব।’’ কখনও এলাকার মঞ্চের সামনে স্লোগানরত আদি তৃণমূল কর্মীদের দেখে পার্থ ভৌমিক আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন এবং বলেন, ‘‘আপনাদের কাছে ক্ষমা চাইছি, আমাদের দলের নেতারা আপনাদের অনেককে মনে রাখতে পারেননি।’’ কখনও আবার কাউন্সিলরদের হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়া নৈহাটি পুরসভার চেয়ারম্যান অশোক চট্টোপাধ্য়ায় ভাষণ দিতে দিতে কেঁদে ফেলেন। দ্রুত তার কাঁধে হাত রেখে মাইক্রোফোন নিজের হাতে তুলে নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেন এলাকার বিধায়ক পার্থ।

আরও পড়ুন: অর্ণবকে জেরা করতেই সারদার ২ ট্রাঙ্ক নথির হদিশ! কোথায় ছিল এত নথি, উঠছে প্রশ্ন

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মঞ্চে পৌঁছন বিকেল ৫টা ২৫ নাগাদ। ঘরছাড়াদের ঘরে ফেরাতেই যে তিনি নৈহাটিতে এসেছেন, সেকথা মনে করিয়ে দেন নিজের ভাষণে। বক্তৃতার মাঝপথে ফের শাসানি দেন পুলিশকে। বলেন, ‘‘আজ আমি এখান থেকে চলে যাওয়ার পর যদি একটি অত্যাচার হয়, আমি ডিজির কাছে হিসেব বুঝে নেব।’’ কণ্ঠস্বর তুঙ্গে তুলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আরও বলেন, ‘‘গুন্ডামি? বোমার কারখানা? একটা বোমা যেন এলাকায় না থাকে। একটা অস্ত্র যেন এলাকায় না থাকে। সে যত বড়ই নেতা হোক, আমি কিন্তু এগুলো সহ্য করব না। মনে রাখবেন, কাল থেকে আইন- শৃঙ্খলা আমার হাতে এসেছে এবং আইন আইনের পথে চলবে।’’

এদিনের সত্যাগ্রহ মঞ্চ থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছেন যে তিনি আরএসএসের পাল্টা হিসেবে ‘জয় হিন্দ বাহিনী’ গড়ে তুলবেন। মঞ্চে দাঁড়িয়েই জ্যোতিপ্রিয় মল্লিককে তাঁর নির্দেশ, অবিলম্বে ব্যারাকপুরের সব ব্লকে জয় হিন্দ বাহিনী গঠন করতে হবে ছাত্র-যুবদের নিয়ে। একই ভাবে এলাকায় এলাকায় মহিলাদের নিয়ে গঠন করতে হবে ‘বঙ্গজননী বাহিনী’। জয় হিন্দ বাহিনীর সদস্যদের জন্য সাদা পায়জামা এবং হলুদ পাঞ্জাবির ব্যবস্থা করতে দলকে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। প্রত্যেককে একটা করে পরিচয়পত্র ও একটা করে ‘শান্তিনিকেতনি ডান্ডা’ দেওয়ার নির্দেশও তৃণমূল নেত্রী দিয়েছেন। আর বঙ্গজননী বাহিনীর সদস্যাদের জন্য নেত্রীর পছন্দ সাদা শাড়ি, যার একদিকের পাড় হবে সবুজ, আর একদিকে লাল। প্রথমে ব্যারাকপুর তথা উত্তর ২৪ পরগনায়, পরে গোটা রাজ্যে এই দুই বাহিনী গড়ে তুলতে হবে বলে মমতা এদিন নিজের দলকে নির্দেশ দিয়েছেন।

মুকুল রায় বা অর্জুন সিংহের নাম এদিন একবারও উচ্চারণ করেননি মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু তার ভাষণের অনেকটা অংশ জুড়েই ইঙ্গিতে আক্রমণের নিশানায় ছিলেন মুকুল-অর্জুন। মুকুলকে ‘বড় গদ্দার’ এবং অর্জুনকে ‘মেজ গদ্দার’ বলে সম্বোধন করেছেন তিনি। মুকুলের রাজনৈতিক গুরু হিসেবে যিনি পরিচিত ছিলেন, সেই মৃণাল সিংহরায়ের মৃত্যুর ঘটনায় এফআইআর যে মুকুলের বিরুদ্ধে হয়ে রয়েছে, সেকথা মৃণালের বোনকে পাশে দাঁড় করিয়ে এদিন মনে করিয়ে দিয়েছেন মমতা। আর মেজ গদ্দার বেনামে জুটমিল চালাচ্ছেন বলে জানিয়ে মমতার ইঙ্গিত, বেআইনি কারবার কী ভাবে আর চলে তা তিনি দেখে নেবেন।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষণে এদিন বারবার শোনা গিয়েছে বিজেপির তীব্র বিরোধিতা। শুরু করেছিলেন বিজেপির প্রতি ঘৃণা বর্ষণ করে। গোটা ভাষণ জুড়ে কখনও বলেছেন, ‘ছি: ছি:’, কখনও বলেছেন ‘বিজেপিকে আমি ধিক্কার দি’। ভাষণের শেষ পর্যন্ত বিজেপি বিরোধী স্বর তুঙ্গে তুলে রাখার চেষ্টা করেছেন তিনি। ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে হিংসার যাবতীয় দায় বিজেপির ওপর চাপিয়েছেন এবং ভাষণ শেষ করার আগে ফের প্রশাসনকে সতর্কবার্তা দিয়ে বলেছেন, ‘‘আমি প্রশাসনকে আবার বলে যাব, মিস্টার ডিজি সাহেব, মিস্টার কমিশনার সাহেব আমি চলে যাওয়ার পরে কোনও ঘটনা যদি ঘটে, তাহলে আমায় জানাবেন। কে কত বড় নেতা আর কোন নেতার আন্ডারে কবে কোথায় পালাচ্ছে, আমি ধরে নিয়ে আসব।’

শুধু ঘরছাড়াদের ঘরে ফেরানোর নির্দেশ দিয়েই এদিন মুখ্যমন্ত্রী থামেননি। নৈহাটি পুরসভার চেয়ারম্যানকেও তিনি নির্দেশ দেন, এলাকায় থাকতে এবং চেম্বারের তালা খুলে আবার পুরসভায় বসা শুরু করতে। শুক্রবার সকাল থেকে চেয়ারম্যানকে নৈহাটি পুরসভায় আবার দেখা যাবে কি না, সে উত্তর সময়ই দেবে। কিন্তু গত কয়েকদিন চেয়ারম্যান যাঁর আশ্রয়ে ছিলেন, এদিনও সভা শেষ হওয়ার পরে চেয়ারম্যানকে সেই ববি হাকিমের গাড়িতেই উঠে পড়তে দেখা গিয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE