Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

কাজ শিখিয়েই পথ দেখাচ্ছেন নাসিমা বিবি

তাঁর পরিধি শুধুমাত্র শহুরে নামি-দামী বুটিকের সেলাইয়ের কাজের মধ্যে নয়। এই কাজ করে তিনি নিজে যেমন রোজগার করছেন, তেমনি সংখ্যালঘু মহিলাদের স্বনির্ভরতার পথও দেখাচ্ছেন।

কাজে ব্যস্ত মহিলারা। ইনসেটে, নাসিমা বিবি। ছবি: বিকাশ মশান

কাজে ব্যস্ত মহিলারা। ইনসেটে, নাসিমা বিবি। ছবি: বিকাশ মশান

অর্পিতা মজুমদার
লাউদোহা শেষ আপডেট: ০৯ মার্চ ২০১৮ ০১:৩০
Share: Save:

তাঁর পরিধি শুধুমাত্র শহুরে নামি-দামী বুটিকের সেলাইয়ের কাজের মধ্যে নয়। এই কাজ করে তিনি নিজে যেমন রোজগার করছেন, তেমনি সংখ্যালঘু মহিলাদের স্বনির্ভরতার পথও দেখাচ্ছেন।

দীর্ঘদিন ধরে এই কাজই করে চলেছে দুর্গাপুর-ফরিদপুর ব্লকের লবনাপাড়ার বাসিন্দা নাসিমা বিবি।

গ্রামের মাঝামাঝি নাসিমা বিবির বাড়ি। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, বাড়ির উঠোনে প্রায় ১৫ জন মেয়ে কাজ করছেন। কেউ কাঁথা স্টিচের ডিজাইন তুলছেন একটি সিল্কের শাড়িতে। কেউ আবার গুজরাতি ফোঁড় তুলছে। কেউ বা কাশ্মিরী ফোঁড় তুলছেন শালে। দাওয়ায় বসে শাড়িতে স্টিচের কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে চোখ তুলে দেখে নিচ্ছেন— বাকিদের কাজ ঠিকঠাক হচ্ছে কি না, কারও কোনও সমস্যা হচ্ছে কি না। কেউ সমস্যায় পড়লেই নাসিমাকে ডাকছেন। তিনি গিয়ে দেখিয়েও দিচ্ছেন।

নাসিমার বাপেরবাড়ি বীরভূমের ইলামবাজারে। খুব কম বয়সে বিয়ে হয়ে চলে আসেন লবনাপাড়ায়। ছোটবেলায় মামার কাছে শিখেছিলেন কাঁথা স্টিচের কাজ। বিয়ের বছর চারেক পরে দুই ছেলে কিছুটা বড় হতে, শ্বশুরবাড়িতে নাসিমা নতুন করে সেলাইয়ের কাজ শুরু করার পরিকল্পনা করেন। ইলামবাজার এলাকার বিভিন্ন বুটিক থেকে কাজের বরাত নিয়ে আসতেন তিনি। এরপরে সংসারের কাজকর্ম সামলে অবসর সময়ে সেলাইয়ের কাজে নিজেকে সম্পূর্ণ নিযুক্ত করতেন তিনি। এ ভাবে শুরু হয় রোজগার। এ ভাবে বাড়িতে বসে রোজগারের খবর ছড়িয়ে পড়ে গ্রামের অন্যান্য পাড়ায়। ৫ জন, ১০ জন করে লবনাপাড়ায় তাঁর কাছে কাজ শিখতে আসতে শুরু করেন অন্য পাড়ার মেয়ে-বৌ’রা।

শুধু কাজ শিখিয়ে থেমে নেই নাসিমা। তিনি পরিকল্পনা করেন, শেখা শেষ হলে সকলকে একসঙ্গে নিয়ে কাজ করার। লক্ষ্যে স্থির থেকে ইলামবাজার, শান্তিনিকেতন ও বীরভূমের অন্য জায়গা থেকে বেশি পরিমাণে কাজের বরাত নিয়ে আসতে শুরু করলেন নাসিমা। সবাই মিলে দ্রুত কাজ শেষ করে তা ফিরিয়ে দিয়ে আবার নতুন কাজ আনতেন নাসিমা। এ ভাবে নিজের রোজগারের পাশাপাশি প্রায় ২০ বছর ধরে গ্রামের অন্য সংখ্যালঘু মহিলাদের আয়ের পথ দেখিয়ে গ্রামে আদর্শ হয়ে উঠেছেন নাসিমা।

ঘরের কাজ সেরে অবসর সময়ে রোজগারের সুযোগ পেয়ে বেঁচে থাকার আনন্দ খুঁজে পেয়েছেন অন্য মেয়েরাও। পরিবারে আর্থিক সাহায্যের পাশাপাশি আর্থিক স্বয়ম্ভরতা এনে দিয়েছে স্বাধীনতার স্বাদ। গৃহবধূ রাজিয়া শেখ জানান, ১২ বছর আগে বিয়ে হয়ে গ্রামে এসেছেন তিনি। নাসিমাকে দেখে অনুপ্রাণিত তিনি। তাঁর কাছে সেলাইয়ের কাজ শিখে মাসে গড়ে দেড় থেকে দু’হাজার টাকা রোজগার করেন রাজিয়া। তাঁর কথায়, ‘‘সংসার সামলে অবসর সময়ে কাজ করি। সারাদিন কাজ করলে অনেক বেশি রোজগার করা যায়।’’ লবনাপাড়া হাইস্কুল থেকে এ বার মাধ্যমিক দিচ্ছে নুরমিনা খাতুন। তার কথায়, ‘‘পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে কাজ করতে খুব ভাল লাগে। অন্য কিছু করে সময় নষ্ট করার মানে হয় না।’’ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পরে কাজে লেগে পড়েছে আসমা খাতুনও। সে জানায়, মাসে গড়ে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা আয় হয় তার। একই কথা জানিয়েছেন, সামসুনিয়ার মির্দা, রুকসানা খাতুনেরাও।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেলাইয়ের কাজেও বিবর্তন এসেছে। নতুন নতুন ডিজাইন এসেছে। নাসিমা বিবি তাই নিরন্তর নিজেকে যুগপোযোগী করে তোলার চেষ্টা করে থাকেন। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রকল্পে যোগ দিয়ে নতুন নতুন সেলাই শিখে নেন তিনি। এরপরে মেয়েদের তা শিখিয়ে দেন। বিভিন্ন বুটিক থেকে শাড়ি, শাল, রুমাল, বিছানার চাদর, চুড়িদার ও ব্লাউজ পিস-সহ অন্য কাঁচামাল আসে। সেগুলিতে সুতো দিয়ে সেলাইয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন ডিজাইন ফুটিয়ে তোলা হয়। এ ভাবেই শান্তিনিকেতন, দুর্গাপুরের বিভিন্ন বুটিকে তাঁদের হাতে তৈরি সম্ভার বাজার মাত করে চলেছে।

কী বলছেন নাসিমা? তাঁর কথায়, ‘‘আমরা আনন্দের সঙ্গে কাজ করি।’’ তিনি জানান, রোজগারের আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে বিষাদও রয়েছে। আড়ালে থেকে সেলাইয়ের কাজ করে যান তাঁরা। মজুরি হিসেবে যে পারিশ্রমিক তাঁরা পান, তা বেশ কম। অথচ তাঁদেরই সৃষ্টি শহরের নামি-দামী বুটিকে বিক্রি হয় চড়া দামে। তাঁদের পরিশ্রমের উপযুক্ত মূল্য পেলে আরও ভাল হয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

International Women's Day Self Help Group Income
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE