Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

রাজমিস্ত্রির কাজেই লড়াই বেলিদিদির

লাঙলের মুঠি আর কর্ণিক (বাড়ি তৈরির এক রকম মাপক যন্ত্র) ধরতে নেই মহিলাদের— সেই সংস্কারের বেড়া ভাঙলেন বেলি সরেন। অন্য মহিলাদেরও নতুন পথে এগোনোর দিশা দিলেন তিনি। পাশে দাঁড়ালেন পরিজন, সহকর্মীদেরও।

নির্মাণ: বাড়ি তৈরির কাজে ব্যস্ত বেলি সরেন। ছবি: কল্যাণ আচার্য

নির্মাণ: বাড়ি তৈরির কাজে ব্যস্ত বেলি সরেন। ছবি: কল্যাণ আচার্য

অর্ঘ্য ঘোষ
নানুর শেষ আপডেট: ০৯ মার্চ ২০১৮ ০২:০৩
Share: Save:

লাঙলের মুঠি আর কর্ণিক (বাড়ি তৈরির এক রকম মাপক যন্ত্র) ধরতে নেই মহিলাদের— সেই সংস্কারের বেড়া ভাঙলেন বেলি সরেন। অন্য মহিলাদেরও নতুন পথে এগোনোর দিশা দিলেন তিনি। পাশে দাঁড়ালেন পরিজন, সহকর্মীদেরও।

নানুরের কীর্ণাহার মাস্টারপাড়ার বাসিন্দা ৫৮ বছরের বেলি। আদিবাড়ি ছিল কড়েয়া গ্রামে। ৫ ভাই, চার বোনের সংসার। বেলিই সবার ছোট। স্থানীয় এক তরুণের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই ঘটে বিবাহবিচ্ছেদ। তখনও কিশোরী বেলি। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে তাঁর। বৃদ্ধ বাবা-মাকে ছেড়ে দাদাদের তখন আলাদা সংসার। দিদিরাও নিজের সংসারে ব্যস্ত। বৃদ্ধ বাবা-মা অক্ষম। বাপের বাড়িতে ফিরে তাঁদের দায়িত্ব নিতে হয় তাঁকেই।

কোথাও মেলেনি কাজ। শেষে রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে হন তিনি। অল্প টাকায় জোড়াতালি দিয়েও সংসার চলত না। বেলিদেবী জানান, দিনবদলের আশায় কীর্ণাহারের রৌশন শেখের কাছে রাজমিস্ত্রির কাজ শিখতে শুরু করেন।

তরুণীর হাতে কর্ণিক দেখে সামাজিক নিয়মের কথা তুলেছিলেন অনেকে। সে সব কানে তোলেননি বেলি। এ সব ছিল ৩৮ বছর আগের কাহিনি। সেই কাজ করেই এখন দিন বদলেছে বেলি সরেনের। কীর্ণাহার মাস্টারপাড়ায় জায়গা কিনে নিজে তৈরি করেছেন একতলা পাকাবাড়ি। শুধু নিজে ঘুরে দাঁড়াননি, সহকর্মীদেরও ঘুরে দাঁড়ানোর পথ দেখিয়েছেন। তাঁর কাছে রাজমিস্ত্রির কাজ শিখেছেন বুড়ো টুডু, টুটুই টুডুর মতো জনাদশেক জোগাড়ে। তাঁদের কথায়— ‘‘আগে দিনে ১৫০-২০০ টাকায় জোগাড়ের কাজ করতাম। বেলিদিদির কাছে কাজ শিখে এখন ৩৫০-৪০০ টাকা রোজগার করছি।’’

সামাজিক বিধিনিষেধ ভেঙে অসহায় মহিলাদের পাশেও দাঁড়িয়েছেন ওই আদিবাসী মহিলা। দিনে তাঁর সঙ্গে গড়ে ৬ জন জোগাড়ের কাজ করেন। তাঁদের মধ্যে ৪ জনই মহিলা। তাঁদেরও রাজমিস্ত্রির কাজের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন বেলিদেবী। মঙ্গলি সরেন, সন্ধ্যা টুডুর মতো মহিলারা বলেন, ‘‘রাজমিস্ত্রির কাজ শিখতে দেখে প্রথম প্রথম অনেকে অনেক কথা বলেছিল। বেলিদিদিকে দেখে সে সব কানে তুলিনি। কিছু দিন পর আমরাও রাজমিস্ত্রির কাজে আরও বেশি টাকা আয় করতে পারব।’’

পরিজনদেরও ভোলেননি তিনি। বেলিদেবীর এক দাদা চলাফেরার ক্ষমতা হারিয়েছেন। স্বামীকে হারিয়ে অসহায় এক বোন। দু’জনেই জানান, ‘‘টাকার অভাব হলেই সাহায্যের হাত এগিয়ে দেয় বেলি। রাজমিস্ত্রির কাজ শিখেছিল বলেই এখন এমন করতে পারে।’’ দিন বদল কিন্তু সহজ ছিল না বেলিদেবীর। সে সবের কথা আজও স্পষ্ট মনে রয়েছে তাঁর। ওই মহিলা জানান, ‘‘জোগাড়ের কাজ করে বাবা-মায়ের চিকিৎসা করে তিন জনের সংসার চলত না। রাজমিস্ত্রির কাজ শিখব ঠিক করি। অনেকে বলেছিল, মেয়েদের কর্ণিক ধরতে নেই। কানে তুলিনি। কোনও মেয়ে রাজমিস্ত্রির কাজ করলে গৃহস্থের অকল্যাণ হবে বলে ভাবতেন কেউ কেউ। তাই কাজ দিতেন না। প্রথম প্রথম সরকারি ঠিকাকাজ করেছি।’’

পাঁচ দশক ধরে রাজমিস্ত্রির কাজ করছেন ময়ূরেশ্বরের সন্ন্যাসী দাস, লাভপুরের কালীচরণ দাস। তাঁরা বলেন, ‘‘মেয়েরা বিমান, ট্রেন চালাচ্ছে বলে শুনেছি। কিন্তু মহিলা রাজমিস্ত্রি চোখে পড়েনি। বেলি সরেন সেটাই বাস্তবে করে দেখিয়েছেন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mason International Women's Day
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE