Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

চেনা গ্রামে কফিনবন্দি হয়ে ওঁরা ফিরলেন

এ দিনই ভোর সাড়ে ৫টা নাগাদ কলকাতা বিমানবন্দর থেকে সরাসরি গাড়িতে দেহগুলি নিয়ে বাহালনগরে পৌঁছন রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। সাদা কাপড়ে মোড়া দেহগুলি পৌঁছে দেওয়া হয় বাড়িতে। 

জানাজার নমাজের আগে। বৃহস্পতিবার বাহালনগরে। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়

জানাজার নমাজের আগে। বৃহস্পতিবার বাহালনগরে। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়

বিমান হাজরা
বাহালনগর শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০১৯ ০৩:০১
Share: Save:

রুজির টানে কাশ্মীরে গিয়ে নিজের গ্রামে কফিন-বন্দি হয়ে ফিরে এলেন ওঁরা।

বৃহস্পতিবার দুপুরে তাঁদের আজন্ম চেনা ধানি মাঠ বেনেপুকুরের কোল ঘেঁষেই একে একে সেই কফিনগুলো পাড়ি দিল গ্রামের অদূরের মাঠে। পর পর মাটি দেওয়া হল কাতরাসুতে জঙ্গি-গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া পাঁচ শ্রমিক— কামিরুদ্দিন শেখ (৩২), রফিকুল শেখ (২৮), রফিক শেখ (৩৫), মুরসালিম শেখ (৩৫) এবং নইমুদ্দিন শেখের (৩৮) দেহে।

এ দিনই ভোর সাড়ে ৫টা নাগাদ কলকাতা বিমানবন্দর থেকে সরাসরি গাড়িতে দেহগুলি নিয়ে বাহালনগরে পৌঁছন রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। সাদা কাপড়ে মোড়া দেহগুলি পৌঁছে দেওয়া হয় বাড়িতে।

নইমুদ্দিন শেখের বাড়ি গ্রামের মুখে। নতুন কাপড়ে মোড়া দেহ বাড়ির উঠোনে রাখতেই কান্নার রোল ওঠে। ভোরের কুয়াশা ভেঙে পাড়া পড়শিরাও বিড়বিড় করতে থাকেন উঠোনে। স্ত্রী আবিয়া বিবি শুধু তিন ছেলে-মেয়েকে আঁকড়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেন নির্নিমেষ।

রফিকুল শেখের কফিন বাড়ির বারান্দায় রাখতেই তার উপরে আছড়ে পড়লেন স্ত্রী মাবিয়া বিবি। কোলে ৬ মাসের ইস্তাককে নিয়ে হাহাকারে ভারী হয়ে উঠেছে সকালের বাতাস। বাবার মুখের দিকে চুপ করে তাকিয়ে আছে পাঁচ বছরের ফিরোজা।

স্বজন হারিয়ে: কাশ্মীরে নিহত শ্রমিকের দেহ নিয়ে গ্রামবাসীরা। বৃহস্পতিবার মুর্শিদাবাদের বাহালনগরে। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়

ছবিটা একই রকম কামিরুদ্দিনের বাড়িতে। মেয়ে রহিমা খাতুনের কিডনির সমস্যা বলেই বাড়তি রুজির টানে কাশ্মীরে পাড়ি দিয়েছিলেন তিনি। রহিমা তাই নাগাড়ে ফুঁপিয়ে চলেছে, ‘‘আমার জন্যই তোমায় চলে যেতে হল আব্বা!’’

খবর পেয়েই বাড়িতে এসেছিলেন রফিক শেখের তিন মেয়ে। দু’দিন ধরে কান্নায় চোখের জল যেন শুকিয়ে গিয়েছে স্ত্রী কামিরুন বিবির। মা না মেয়ে, কে কাকে সান্ত্বনা দেবে, বুঝেই উঠতে পারছে না তখন।

মুরসালিমের মৃতদেহ বাড়িতে পৌঁছতেই তাঁর ৭৫ বছরের বাবা আমির হোসেন উন্মাদের মতো ছটফট করতে থাকলেন, ‘‘এমনটাও দেখতি হল আমায়, এমনটাও...।’’ ছেলের ক্ষতবিক্ষত দেহ খুলতে চাইছিলেন না পাড়া-পড়শি। কিন্তু আমির অনড়, ‘‘এক বার দেখতি দাও ওরে!’’

গ্রামে কফিন এসেছে— খবর ছড়িয়ে পড়তেই, এ দিন ভোর থেকে আশপাশের গ্রাম থেকে ভিড় ভাঙতে শুরু করে বাহালনগরে। সঙ্গে প্রশাসন-পুলিশ আর সংবাদমাধ্যমের গাড়ির ভিড়। সরু গলির মতো রাস্তাগুলি যেন জনসমুদ্র। জাতীয় সড়কে দাঁড়িয়ে পড়েছে দূরপাল্লার বাস— সবাই এক ঝলক দেখতে চান হারানো মানুষগুলোকে। অবস্থা সামাল দিতে তখন পুলিশের নাজেহাল অবস্থা।

বেলা একটু বাড়তে বাড়ি থেকে দেহগুলি বার করে এনে রাখা হল গ্রামের অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের সামনে। সেখানেই নেতা-মন্ত্রী-প্রশাসনের কর্তারা মালা দিলেন মরদেহে। গ্রামের যুবকেরা সবার বুকে একে একে কালো ব্যাজ পরিয়ে দিলেন। তার পর শুরু হয় কাঁধে কাঁধে তাঁদের শেষ যাত্রা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE