রূপজান ঘরামি, জাইনাব ফারিন এবং সায়রা খাতুন।
জাইনাব ফারিন, সায়রা খাতুন, রূপজান ঘরামি— কেউ কাউকে চেনে না।
কোথায় উত্তর ২৪ পরগনার বারাসত, কোথায় পুরুলিয়ার মানবাজার আর কোথায় দক্ষিণ ২৪ পরগনার মথুরাপুর! তবু তিন কন্যার ‘লড়াই’টা একই রকম। তাদের কৃতিত্ব এখন পরিবারকেও আলো দিচ্ছে। তিন জনেরই পরিজনেরা ভুল স্বীকার করছেন। কী সেই ভুল? কম বয়সে মেয়ের বিয়ের চেষ্টা।
২০১৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর সকালে মানবাজার থানায় হাজির জবলা গ্রামের সায়রা খাতুন। গোপালনগর আশুতোষ হাইস্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী। বয়স পনেরো। জানায়, বাড়ি থেকে বিয়ের তোড়জোড় চলছে। কিন্তু সে চায় ফুটবল খেলতে। থানায় ডাক পড়ে অভিভাবকদের। বন্ধ হয় বিয়ের কথা। সেই সময়ে অভিভাবকদের চিন্তা ছিল, রোজ সাতসকালে ফুটবল নিয়ে মাঠের দিকে ছুট দেয় যে মেয়ে, তার বিয়ে দিতে না সমস্যা হয়।
এখন অবশ্য ওই কিশোরীর দাদু কবীর আনসারি বলছেন, ‘‘আমাদেরই ভুল ছিল। এখন বুঝতে পারি।’’ সায়রার হাত ধরে এলাকার খেলাধুলোর ছবিটাই একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে বলে জানাচ্ছেন গোপালনগর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক তপনকুমার মাহাতো। তাঁর কথায়, ‘‘সায়রা আমাদের কন্যাশ্রী ক্লাবের ভাল ফুটবলার। গ্রামের কয়েক জন মেয়েকেও নিয়মিত অনুশীলন করায়। ওকে দেখে স্কুলের অনেক মেয়ের ফুটবলে আগ্রহ বে়ড়েছে।’’
আরও পড়ুন: মুচলেকা সার? বন্ধ হয়নি নাবালিকা বিয়ে
বারাসতের ময়নার বাসিন্দা জাইনাবের লড়াই শুরু হয়েছিল ২০১১ সালে। জাইনাব তখন দ্বাদশ শ্রেণি। বাবা নেই। ঋণের জালে জড়িয়ে মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছিলেন মা। বারাসত থানার পুলিশের কাছে গিয়ে বিয়ে রুখে জাইনাবের ঠাঁই হয় হোমে। সেখান থেকে পড়াশোনা চালিয়ে সেই মেয়ে এখন কল্যাণী পাবলিক স্কুলে কম্পিউটর প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন। তাঁর উপার্জনের অর্থে ভাইবোনের পড়াশোনার খরচ জোগাচ্ছেন। চালাচ্ছেন সংসার। দেখছেন অসুস্থ মাকেও। তবে পড়াশোনা থামেনি। ইংরেজিতে স্নাতকোত্তরে শেষ বর্ষে পড়াশোনা করছেন তিনি। লক্ষ্য, আরও ভাল চাকরি। যাতে নিজের পরিবারকে দেখা যায়। পাশে দাঁড়ানো যায় আরও অনেক জাইনাবের।
আরও পড়ুন: সন্তান জন্মের ১৬ দিনের মাথায় ডেঙ্গিতে মৃত্যু মায়ের, অসুস্থ সদ্যোজাত
ঋণ শোধ করতে গিয়ে ময়নায় জাইনাবদের বাড়ি বিক্রি হয়ে গিয়েছে। হোম থেকে বেরিয়ে সপরিবারে ওই এলাকাতেই ভাড়া রয়েছেন জাইনাব। পুরনো কথা বলতে গিয়ে এখনও কেঁপে ওঠেন যুবতী। তাঁর কথায়, ‘‘অসময়ে বিয়েতে মেয়েটি শুধু নয়, ভবিষ্যতে সন্তান, পরিবারেরও যে কতটা ক্ষতি হয় না বুঝলে কী করে হবে! সে জন্য চাই শিক্ষা, নিজের পায়ে দাঁড়ানো।’’
নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্যই বছরখানেক আগে নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে যেতে দ্বিধা করেনি মথুরাপুরের মানিকতলা গ্রামের মোটরভ্যান চালক রূপচাঁদ ঘরামির পাঁচ ছেলেমেয়ের মধ্যে বড় রূপজান। সে তখন নবম শ্রেণির ছাত্রী। চোখে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন। কিন্তু বাড়ির লোকজন বিয়ে ঠিক করায় তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়। মানতে পারেনি মেয়েটি। আবার বাবা-মায়ের মুখের উপরে নিজের আপত্তির কথা সে জানাতেও পারেনি। জানিয়েছিল বন্ধুদের।
ঠিক বিয়ে শুরুর মুহূর্তে বন্ধুরা স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং পুলিশ নিয়ে হাজির হয়। বন্ধ হয় বিয়ে। রূপচাঁদ এখন বলেন, ‘‘সে দিন বুঝতে পারিনি। ও বড় হোক। ওর স্বপ্ন পূরণ হোক। তাতে আমাদেরই গর্ব হবে।’’
তিন কন্যার মতো লড়াইয়ের নজির রয়েছে আরও। সংখ্যাটা যত বাড়বে, তত নাবালিকা বিয়ের সংখ্যা কমবে বলে মনে করছেন প্রশাসনের কর্তারা।
(তথ্য সহায়তা: দিলীপ নস্কর)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy