Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

নরমে গরমে পাহাড়ের প্রভুত্ব হাতেই রাখতে চাইছে মোর্চা

দলের সভাপতি বিমল গুরুঙ্গ সহ প্রথম সারির ৯ নেতার নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হতেই ফের নরমে-গরমে পাহাড়ের রাশ হাতে রাখতে আসরে নেমে পড়েছে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। রবিবার সকালে মোর্চার নেতারা জানিয়ে দেন, তাঁরা বন্ধ করবেন না। কিন্তু তারপরেও কোথাও হুমকি দিয়ে, কোনও জায়গায় ‘জনতা’র নামে পোস্টার সেঁটে পাহাড়ের ৩ মহকুমার সব দোকান বন্ধ করানো হয়। বিকেলে আবার মোর্চার তরফে ব্যবসায়ীদের অনুরোধ করে কিছু দোকান খোলানোও হয়েছে।

সুকনায় বন্ধ মোর্চার দফতর।

সুকনায় বন্ধ মোর্চার দফতর।

কিশোর সাহা
দার্জিলিং শেষ আপডেট: ০৮ জুন ২০১৫ ০৪:১৫
Share: Save:

দলের সভাপতি বিমল গুরুঙ্গ সহ প্রথম সারির ৯ নেতার নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হতেই ফের নরমে-গরমে পাহাড়ের রাশ হাতে রাখতে আসরে নেমে পড়েছে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। রবিবার সকালে মোর্চার নেতারা জানিয়ে দেন, তাঁরা বন্‌ধ করবেন না। কিন্তু তারপরেও কোথাও হুমকি দিয়ে, কোনও জায়গায় ‘জনতা’র নামে পোস্টার সেঁটে পাহাড়ের ৩ মহকুমার সব দোকান বন্ধ করানো হয়। বিকেলে আবার মোর্চার তরফে ব্যবসায়ীদের অনুরোধ করে কিছু দোকান খোলানোও হয়েছে।

মোর্চা বিরোধী জোট ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের অন্যতম মুখপাত্র প্রতাপ খাতির বক্তব্য, ‘‘এটা গুরুঙ্গদের পুরানো কায়দা। মুখে বলবে শান্তি-গণতন্ত্রের কথা। তলে তলে হুমকি দেবে। অশান্তি করবে। এখনও তা-ই হচ্ছে। খুকরি হাতে ঘুরে অনেকে ভয় দেখাচ্ছে।’’ তবে তাঁর দাবি, পাহাড়ের মানুষ মোর্চার এই কৌশল ধরে ফেলেছেন। প্রতাপবাবুর বক্তব্য, ‘‘তামাঙ্গ খুনের মামলার শতাধিক সাক্ষী রয়েছেন। তাঁদের ভয় দেখানো হতে পারে। তাই গুরুঙ্গদের তাড়াতাড়ি গ্রেফতার করে জেলে পাঠানোর দাবিতে পাহাড়বাসী একজোট হচ্ছেন।’’

সেই সঙ্গে প্রতাপবাবুর দাবি, অবিলম্বে গুরুঙ্গ, রোশন গিরিদের পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করতে হবে। তাঁর সন্দেহ, গুরুঙ্গেরা উত্তর পূর্ব ভারত হয়ে বিদেশে গিয়ে আত্মগোপন করতে পারেন। পেশায় আইনজীবী প্রতাপবাবুর বক্তব্য, ‘‘মদন তামাঙ্গ খুনে অভিযুক্ত নিকল তামাঙ্গ পালিয়ে বিদেশে গিয়েছে শুনেছি। অস্ত্র আইনে অভিযুক্ত জিটিএ সদস্য সঞ্জয় থুলুঙ্গ কোথায়, তা-ও পুলিশ জানে না। কাজেই এ বারও যে তেমন হবে না, সেই নিশ্চয়তা কে দেবে!’’

মোর্চা অবশ্য প্রতাপবাবুর অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছে। রবিবার দুপুরে দার্জিলিঙের ভানু ভবনে জিটিএ সদস্যরা (চার্জশিটে অভিযুক্ত ৯ জন সেখানে ছিলেন না) বৈঠক করেন। সেখানে দলীয় পর্যায়ের বৈঠকও হয়। পরে মোর্চার কেন্দ্রীয় কমিটির প্রবীণ নেতা শাওন রাই বলেন, ‘‘আমরা পাহাড়ে কোনও বন্‌ধ চাই না। শান্তি যেন থাকে। দলের সব কমিটিকেও সে কথা বলা হয়েছে।’’ পরে বিকেলে জিটিএ-র তরফে কার্শিয়াঙের গিদ্দে পাহাড়ের সদস্য অনীত থাপা জানান, তাঁরা আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমেই পরিস্থিতির মোকাবিলা করবেন।

তা হলে কারা পাহাড়ে পোস্টার দিচ্ছেন? কারাই বা ব্যবসায়ীদের হুমকি দিচ্ছেন? কারা খুকরি হাতে ভয় দেখাচ্ছেন?

সরকারি ভাবে মোর্চা নেতাদের দাবি, এ সবই বিরোধীদের একাংশের চক্রান্ত। তবে মোর্চার কেন্দ্রীয় কমিটি সূত্রেই জানা গিয়েছে, মোর্চা বিরোধীরা ইতিমধ্যেই পাহাড়ের মানুষকে কাছে টানতে আসরে নেমে পড়েছে। এখন মোর্চার শীর্ষ নেতাদের কয়েকজন জেলে চলে গেলে, বিরোধীরা পাহাড়ে মোর্চার পায়ের তলার মাটি কেড়ে নিতে চেষ্টা করবে। তা রুখতেই দলের তরফে দ্বিমুখী কৌশল নেওয়া হয়েছে বলে একান্তে স্বীকার করেন ওই নেতারা।

তবে এই মুহূর্তে পাহাড়ে বিরোধী জোটের জন সমর্থন মোর্চার তুলনায় খুবই সামান্য। তবুও ওই জোট নিয়ে এত ভীত কেন মোর্চা?

ঘটনা হল, অতীতে পাহাড় ছাড়া হওয়ার পরে রাজ্যপাট আর ফেরত পাননি সুবাস ঘিসিঙ্গ। তাঁর বিরুদ্ধে জমে থাকা যাবতীয় ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে পাহাড়ে তখন কর্তৃত্ব কায়েম করেছিলেন বিমল গুরুঙ্গ। সেই সময়ে জিএনএলএফ-এর সংগঠন ছিল গোছানো। তুলনায় গুরুঙ্গের দল ছিল একেবারেই আগোছালো। কিন্তু, ঘিসিঙ্গকে পাহড়ে ঢুকতে না দিয়ে গুরুঙ্গ ক্রমাগত জিএনএলএফ নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষকে কাছে টেনে নিয়ে রাজ্যপাট দখল করেছিলেন।

এ বারেও পরিস্থিতি খানিকটা একই রকম। ২০০৭ সাল থেকে পাহাড়ে কর্তৃত্ব কায়েম করার পর প্রায় ৮ বছর কেটে গিয়েছে। গুরুঙ্গদের কাজকর্ম নিয়ে পাহাড়ের নানা মহলে বিরক্তি চরমে। সেই সুযোগ মোর্চা বিরোধীরা নিতে মরিয়া। আজ, সোমবার ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের বৈঠকে এই বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করে কর্মসূচিও ঘোষণা হতে পারে বলে খবর পৌঁছেছে মোর্চার কেন্দ্রীয় অফিসে।

তবে মোর্চার অন্দরে কিন্তু গুরুঙ্গের অবর্তমানে কে দল ও জিটিএ-র দায়িত্ব সামলাবেন তা নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। মোর্চা সূত্রেই জানা গিয়েছে, শনিবার পর্যন্ত ঠিক ছিল, কার্শিয়াঙের জিটিএ সদস্য গুরুঙ্গ ঘনিষ্ঠ অনীত ওই দায়িত্ব সামলাবেন। কিন্তু, রবিবারের বৈঠকে দার্জিলিং ও কালিম্পঙের কয়েকজন প্রতিনিধি তা নিয়ে আপত্তি তোলেন। ফলে, তা নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি। দল সূত্রেই জানা গিয়েছে, তখনই ঠিক হয়, বিজনবাড়ি এলাকার ষাটোর্ধ্ব কৃষক নেতা শাওন রাইকে আপাতত দলের মুখপাত্র হিসেবে সামনে রাখা হবে। কিন্তু, জিটিএ-র কাজে যাতে বিঘ্ন না ঘটে, সে দিকে অনীতবাবুই আপাতত খেয়াল রাখবেন বলে দল সূত্রের খবর।

সব ঠিক থাকলে আজ কলকাতায় উচ্চ আদালতে আগাম জামিনের আবেদন করার কথা গুরুঙ্গদের। মোর্চার একটি অংশের মত, জামিন না মিললে জিটিএ থেকে ইস্তফা দিয়ে গুরুঙ্গদের আত্মসমর্পণ করাই উচিত। কিন্তু, দলের আর একটি অংশের মত, নেতারা জেলে গেলে পাহাড়ে নিজেদের জমি দখলে রাখা শক্ত হবে। সেই আশঙ্কাতেই তাঁরা রাস্তায় নেমে নানা কর্মকাণ্ড করছেন বলে অভিযোগ। মোর্চার কেন্দ্রীয় কমিটির এক নেতাও জানান, যা পরিস্থিতি তাতে দলের সভাপতি সহ ৯ জন জেলে গেলে দল-জিটিএ সামলে দার্জিলিংকে চেনা ছন্দে রাখাটা সহজ হবে না। সে জন্য আজ, সোমবার ফের বৈঠকে বসবে মোর্চাও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE