ছেলেকে কোলে নিয়ে সুচিত্রা। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম।
দেড় বছর আগের এক দুপুরে হঠাৎ বাড়ি থেকে তার মাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ। কেঁদে ভাসিয়ে পুলিশ ভ্যানের পিছনে ছুটেছিল একরত্তি ছেলে। ধুলো উড়িয়ে তার মাকে নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল পুলিশ ভ্যান। বুধবার, আরও একটা দুপুরে কালো রঙের গাড়িটা যখন বাড়ির সামনে দাঁড়াল, চোখ ছলছল করে উঠল বছর তেরোর এক কিশোরের। গাড়ি থেকে নামতেই মাকে খুব করে জড়িয়ে ধরল বাবু।
দীর্ঘ দশ বছর ধরে খুনির তকমা নিয়ে চলা বাবুর মা সুচিত্রা মণ্ডল ক’দিন আগে আদালতে নির্দোষ সাব্যস্ত হন। এ দিন সিউড়ি সংশোধনাগার থেকে ছাড়া পেয়ে এলেন রামপুরহাটে, ছেলের কাছে। ছেলেকে কাছে পেতেই চোখ চিকচিক করে উঠল সুচিত্রারও। কোনও রকমে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘ভাল আছিস? পড়াশোনা করছিস তো?’’ যেন ঘোরের মধ্যে থাকা কিশোর উত্তর দিতে পারল না। ছেলেকে কোলে টেনে চুমু খেলেন মা।
বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ সিউড়ি সংশোধনাগার থেকে বেরোন বছর চল্লিশের সুচিত্রা। বেরিয়েই প্রথম কথা, ‘‘বিনা অপরাধে জেল খাটলাম। এখন স্বস্তি লাগছে। ছেলেটাকে দেখতে চাই।’’ সে সময় সুচিত্রাকে নিতে সেখানে তাঁর পরিবারের কেউ উপস্থিত ছিলেন না। কারা-কল্যাণ আধিকারিক শুভদীপ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ওঁর দেওয়া সব ক’টি নম্বরেই চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।’’ কারা কর্তৃপক্ষের পরামর্শে জেলে পরিজনের সঙ্গে দেখা করতে আসা কয়েকজনের সঙ্গে সুচিত্রা প্রথমে ময়ূরেশ্বরের ঘোষগ্রামে বাপের বাড়িতে ফেরার কথা ভাবেন। পরে দুপুর ১টা নাগাদ তাঁর বোনঝি পিঙ্কি কবিরাজ (যিনি রামপুরহাট কোর্টের আইনজীবী) মাসিকে নিতে সিউড়িতে আসেন। তাঁর সঙ্গেই রামপুরহাটে দিদির বাড়িতে ছেলের কাছে যান সুচিত্রা। ২০০৬-এর ৪ এপ্রিল মাড়গ্রাম থানার পোড্ডা গ্রামে খুন হন সুচিত্রার দেওর অশোক মণ্ডল (২৮)। ঘটনার সময় সুচিত্রাদেবী স্বামী কার্তিক মণ্ডলের সঙ্গে তারাপীঠে ভাড়াবাড়িতে থাকতেন। তারাপীঠে তাঁদের একটি তেলেভাজার দোকান ছিল। অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ দায়ের করেন কার্তিক। ঘটনার দু’সপ্তাহ পরে ওই খুনে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ সুচিত্রাকেই ধরে। ওই বছরই ১৯ জুন রামপুরহাট আদালতে পুলিশ সুচিত্রা-সহ স্থানীয় চার জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়। ২০০৯-এর ২১ মার্চ রামপুরহাট আদালত চার জনকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। ওই সাজা পুনর্বিবেচনার মামলাতেই গত ৬ অক্টোবর সুচিত্রাকে বেকসুর খালাস করেছে কলকাতা হাইকোর্ট।
২০০৯ থেকে দেড় বছর জেল খেটে হাইকোর্টে জামিন পান সুচিত্রা। যদিও একাধিক শুনানিতে গরহাজির থাকায় (সুচিত্রার দাবি অসুস্থতার জন্য) বছর দেড়েক আগে ফের জেলে যেতে হয় তাঁকে। সেই সময় থেকে রামপুরহাটে মাসির কাছে থাকছে বাবু। অষ্টম শ্রেণির ছাত্রটি বলল, “ঠাকুরের কাছে সব সময় প্রার্থনা করতাম, ‘মাকে ছেড়ে দাও’। আজ মা ঘরে ফিরেছে। এর থেকে আনন্দের কী হতে পারে? তবে পিঙ্কিদিদি না থাকলে মা ঘরে ফিরত পারত না।’’ পিঙ্কি বলেন, ‘‘কেউ দোষ না করলে তিনি ছাড়া পাবেন-ই। এই বিশ্বাস ছিল। তাই মাসির মামলা নিয়ে হাইকোর্টে যাওয়ার জন্য মামাকে (দেবাশিস মণ্ডল) বলেছিলাম। আজ সবাই শান্তি পেলাম।’’
ভাই ও দিদির পরিবারকে পাশে পেলেও সুচিত্রার চিন্তা কম নয়। ফের বিয়ে করেছেন স্বামী। সামনে রয়েছে পৈত্রিক কিছু জমিজমা সামলে দিন চালানোর ঝক্কি। কী করবেন এখন? ‘‘ছেলেই এখন আমার সব। ওকে আঁকড়ে জীবনটা কাটিয়ে দেব,’’—বলছেন সুচিত্রা।
সহ-প্রতিবেদন: দয়াল সেনগুপ্ত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy