কান্নায় ভেঙে পড়েছেন পরিজনেরা। —নিজস্ব চিত্র
নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ছোট ছেলে ভর্তি মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। শনিবার সকালে ছেলের জন্য খাবার নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলেন পলাশির বিবেকানন্দপল্লির উজ্জ্বলা হাজরা (৪৫)। মুখে রুচি নেই বলে উজ্জ্বলাদেবী সাতসকালেই ছেলের জন্য রান্না করেছিলেন ভাত আর কাঁচকলার পাতলা ঝোল। তবে নিজেই স্নান-খাওয়ার সময় পাননি। ভেবেছিলেন, ছেলেকে খাইয়ে বাড়ি ফিরেই স্নান খাওয়া করবেন। কিন্তু তা আর হল না।
মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পদপিষ্ট হয়ে মারা গিয়েছেন উজ্জ্বলাদেবী। উজ্জ্বলাদেবীর পরিবারের লোকজন বলছেন, ‘‘বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় ওই সবাইকে বলে গেল সাবধানে থাকতে। অথচ নিজেই ওই ভিড় সামলে বেরোতে পারল না।’’
পলাশি স্টেশন থেকে ঢিলছোড়া দূরত্বে বিবেকানন্দপল্লি। সেখানেই স্বামী, তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে উজ্জ্বলাদেবীর সংসার। ছেলেদের রোজগারে কোনওমতে দিন চলে। বড় ছেলে প্রসেনজিৎ হাজরা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় কাজ করেন। ছোট ছেলে অভিজিৎ ব্যবসা করেন। গত কয়েকদিন থেকে অভিজিৎ প্রবল জ্বরে ভুগছিলেন। সেই সঙ্গে কাশি। স্থানীয় চিকিৎসককে দেখিয়েও কোনও ফল মেলেনি। শুক্রবার রাতে তাঁকে ভর্তি করানো হয় মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। অভিজিৎ আপাতত হাসপাতালের তিন তলার পাঁচ নম্বর ঘরে আছেন।
হাসপাতালে অভিজিতকে দেখাশোনার সুবিধা হবে বলে বহরমপুরেই ছিলেন স্ত্রী দীপান্বিতা ও বোন পল্লবী। এ দিন অভিজিৎ নিজেই কলার ঝোল দিয়ে ভাত খেতে চান। সেই মতো ছেলের জন্য খাবার নিয়ে বহরমপুরে গিয়েছিলেন উজ্জ্বলাদেবী। ‘ভিজিটিং আওয়ার্সে’ তিনি নিজে হাতে ছেলেকে খাইয়েও দিয়েছেন। কিছুক্ষণ পরেই তাঁদের বাইরে বেরিয়ে আসার কথা ছিল।
ঠিক তখনই হাসপাতালে আগুন লাগার খবরে হইচই শুরু হয়। সকলেই তড়িঘড়ি সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে শুরু করে। সেই ভিড়ের মধ্যে মেয়ে, বৌমার সঙ্গে ছিলেন উজ্জ্বলাও। আচমকা ধাক্কায় সকলের থেকে আলাদা হয়ে যান তিনি। প্রথমে তাঁর বাড়ির লোকজন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেও উজ্জ্বলাদেবীর সন্ধান পাননি।
পরে হাসপাতালে জখম ও মৃতদের শনাক্ত করতে বলা হয়। সেই সময় উজ্জ্বলাদেবীর পরিবারের লোকজনও যান। তাঁরাই সেখানে গিয়ে উজ্জ্বলাদেবীর দেহ খুঁজে পান। হাসপাতাল সূত্রে খবর, ভিড়ের মধ্যে নামতে গিয়ে পদপিষ্ট হয়েই মারা গিয়েছেন ওই মহিলা। ঘটনার খবর পেয়েই বহরমপুরে ছুটে আসেন উজ্জ্বলাদেবীর স্বামী বাসুদেববাবু। তিনি বলছেন, ‘‘কী করে এমন হল বলুন তো! গোটা সংসারটাকেই তো ও ধরে রাখত। সব শেষ হয়ে গেল।’’
গোটা হাসপাতাল জুড়ে যখন হইহই চলছে তখন অভিজিৎ গিয়েছিলেন হাসপাতালের শৌচাগারে। প্রথমে তিনি কিছুই বুঝতে পারেননি। ভেবেছিলেন, ভিজিটিং আওয়ার্স শেষ হয়ে গিয়েছে। তাঁর মা ও অন্যান্যরা হয়তো বাড়ি চলে গিয়েছেন। কিন্তু ঘটনার খবর জানতে পারার পরে তিনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। অভিজিতের বন্ধু অমিতাভ সরকার বলেন, ‘‘মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে ও আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে। এখন হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে।’’
উজ্জ্বলাদেবীর এমন পরিণতিতে শোকস্তব্ধ তাঁর পরিবার ও পড়শিরা। ঘটনার খবর পেয়েই তাঁর একচিলতে বাড়িতে ভিড় করেছিলেন সকলেই। পড়শিরা জানাচ্ছেন, ভাল ব্যবহারের জন্য সকলেই তাঁকে পছন্দ করেন। উজ্জ্বলাদেবীও পড়শিদের আপদ-বিপদে ছুটে যেতেন।
দিদির মৃত্যু সংবাদ শুনে বর্ধমান থেকে ছুটে এসেছেন তাঁর বোন নিদ্রা হাজরা। তাঁর কথায়, ‘‘গত কালই দিদি ফোনে বলেছিল পুজোর সময় আসতে। আমিও আসব বলে কথা দিয়েছিলাম। পুজোর অনেক আগেই আমাকে ছুটে আসতে হল। অথচ দিদিই আর নেই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy