কপ্টার থেকে ঝোলা দড়ির শেষে বাঁধা দেহ। বরফের উপর দিয়ে উড়ে চলেছে। ২০১৩ সালের ধৌলাগিরির সেই দৃশ্যটা এখনও চোখে লেগে।
বসন্ত সিংহরায় বেঁচে গিয়েছিলেন। ২০১৪ সালে ইয়ালুংকাং অবশ্য ছন্দা গায়েনকে সেই সুযোগ দেয়নি। আর ২০১৬ সালের মে মাসে দু’টো প্রাণকে হিমালয় ছিনিয়ে নিয়ে গেল। দু’জন এখনও নিখোঁজ।
কেউ শুনে শেখে, কেউ দেখে, কেউ বা ঠেকে। যাঁরা বোধ হয় কিছুতেই শেখেন না, তাঁদেরই বাঙালি পর্বতারোহী বলে।
বসন্তদার বেলায় শেরপা সারা রাত কোথায় ছিল, তা জানা যায়নি। ছন্দার বেলায় কোন পর্বতারোহণের শিক্ষায় তাশি শেরপা নিজেকে দড়িতে না বেঁধে একা-একা চলছিল, তা এখনও জানা যায়নি। সেই তাশিই রাজীবের ( ধৌলাগিরি অভিযানে মৃত পর্বতারোহী রাজীব ভট্টাচার্য) অবসন্ন অবস্থা দেখেও ধৌলাগিরি শিখরের দিকে কেন এগিয়ে গিয়েছিল, কেনই বা সাড়ে ছ’হাজার মিটার উচ্চতার ক্যাম্পে ৬ দিন ছিল, এটা প্রশ্ন।
আমরা, পর্বতারোহীরা এখন শেরপাদের উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি। আগে শেরপারা মাল বইতেন। অভিযাত্রীরা সিদ্ধান্ত নিতেন। শেরপাদের উপযোগিতা পাহাড়ের অভিজ্ঞ পথপ্রদর্শক হিসেবে। যে আরোহী চলেছেন, তাঁকে শেরপারা সুরক্ষিত ভাবে ফিরিয়ে আনবেন। সেই শেরপাদেরই ‘ফ্রেন্ড, ফিলজফার অ্যান্ড গাইড’ করে নিচ্ছি আমরা। তার ফলও ভুগতে হচ্ছে প্রতি পদে।
আসলে এভারেস্ট অর্থাৎ পৃথিবীর মাথায় পা দেওয়ার মোহ তো গ্রাস করছে বাঙালিকে। বসন্ত সিংহরায়, দেবাশিস বিশ্বাস—দু’জনে এভারেস্ট জয়ের পর থেকেই যেন তা আরও চেপে বসেছে। অনেকেই ভাবছেন, দু’জন ভেতো বাঙালি যখন পেরেছে, আমরাও পারব। তা সে অভিজ্ঞতা, প্রশিক্ষণ পর্যাপ্ত থাক বা না-থাক।
এভারেস্টে কেন চড়তে চান? এই প্রশ্নের উত্তরে প্রবাদপ্রতিম পর্বতারোহী জর্জ ম্যালরি বলেছিলেন, ‘‘বিকজ ইট ইজ দেয়ার।’’ জর্জ ম্যালরি তো দূর অস্ত, আমি, বসন্তদা, দেবাশিস—এরাও বহু অভিযানের অভিজ্ঞতার পর এভারেস্টের পথে পা বাড়িয়েছিলাম। এখন তো অনেকে অভিযানের অভিজ্ঞতা খাতা খুলছে এভারেস্ট দিয়ে। আসলে এভারেস্টে উঠলে সংবাদমাধ্যম, সরকার যতটা কৃতিত্ব দেয়, যত নাম কুড়োনো যায়, বাকিগুলিতে হয় না। তাই যত দ্রুত সম্ভব, সব থেকে উপরেই উঠতে হবে।
কিন্তু এভারেস্টে উঠতে হলে যে শারীরিক, মানসিক সক্ষমতা দরকার তা তো সব সময় থাকছে না। টাকা জোগাড়, স্পনসরের পিছনে ছুটতে ছুটতে ঘাটতি থাকছে আসল শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতিতে। সেই কারণেই তিব্বতের দিকের কষ্টসাধ্য নর্থ কল (চিনের দিক) দিয়ে নয়, বেশির ভাগ অভিযাত্রীর পছন্দ নেপালের সাউথ কল। তাই তো ২০১৪ সালে নর্থ কলে যখন ১০৬ জন অভিযাত্রী, তখন সাউথ কলে ছ’শো জনের ভিড়! অথচ সাউথ কলের হিলারি স্টেপের লাইনে দাঁড়িয়ে শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত কমতে থাকে, বাড়ে তুষারক্ষতের আশঙ্কা।
আসলে ঘুরেফিরে আসছে সেই প্রশিক্ষণ-প্রস্তুতির কথাই। মনে রাখতে হবে, পর্বতারোহণের প্রশিক্ষণটা কিন্তু শুধু মাইলের পর মাইল চড়াই-উতরাই পেরোনো নয়! দরকার হিসেব, পরিকল্পনা, দরকার শরীর সম্পর্কে জ্ঞানেরও। এডমন্ড হিলারি বলেছিলেন, ‘‘অভিযান মানে পাহাড়ে চড়া নয়, সুস্থ ভাবে ফিরে আসাটাই আসল।’’ অর্থাৎ পাহাড়ে চড়ার সময় যেন ফিরে আসার শক্তিটাও শরীরে-মনে থাকে। না হলেই বিপদ। বেশির ভাগ দুর্ঘটনা কিন্তু অভিযান থেকে ফিরে আসার পথেই ঘটে। কী ভাবে এই শক্তি বাঁচিয়ে রাখতে হবে, সেটাও জানতে হবে। বোঝা দরকার, সাড়ে পাঁচ হাজার মিটারের উপরে শরীরকে কিন্তু আর খাপ খাওয়ানো যায় না।
এই অভিযানে গিয়ে যাঁরা মারা গেলেন, তাঁরা আমার ভাই-বোনেরই মতো। তাঁদের বাড়ির অবস্থাটা কী, তা-ও বুঝতে পারছি। তাই বলছি, শুধু মোহের বশে আর কত দিন এ
ভাবে ছুটব?
লেখক: ২০১৪ সালে চিনের দিক (নর্থ কল) দিয়ে এভারেস্ট জয়ী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy